ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তি ও রেকর্ড গোলদাতা সুনীল ছেত্রী (Sunil Chhetri) আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ভেঙে মাঠে ফিরছেন। এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর তৃতীয় রাউন্ডের বাছাইপর্বে ভারতের হয়ে তিনি মার্চ মাসে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের বিরুদ্ধে খেলতে নামবেন। ৪০ বছর বয়সী এই তারকা ফুটবলার আগামী ২৫ মার্চ বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর প্রত্যাবর্তন শুরু করবেন।
গত বছরের জুন মাসে ফিফা বিশ্বকাপ ২০২৬-এর বাছাইপর্বে কুয়েতের সঙ্গে গোলশূন্য ড্রয়ের পর সুনীল আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা করেছিলেন। তবে তিনি ক্লাব ফুটবলে বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) খেলা চালিয়ে গেছেন। এই মরশুমে তিনি ১২টি গোল করে আইএসএল-এর সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতার খেতাব অর্জন করেছেন। ২৩টি ম্যাচে মাঠে নেমে ১৭টিতে শুরু থেকে খেলেছেন এবং ১৪টি গোলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যার মধ্যে দুটি অ্যাসিস্ট রয়েছে।
সুনীলের অবিশ্বাস্য রেকর্ড
৯৪টি আন্তর্জাতিক গোল নিয়ে সুনীল ছেত্রী পুরুষ ফুটবলে বিশ্বের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা। তাঁর উপরে রয়েছেন শুধু ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওনেল মেসি এবং আলি দায়ি। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে তিনি একটি জীবন্ত কিংবদন্তি। অবসরের ঘোষণার সময় তিনি বলেছিলেন, “অবসরের সিদ্ধান্ত শারীরিক কারণে নয়। আমি এখনো ফিট, দৌড়াতে পারি, ডিফেন্ড করতে পারি, কঠোর পরিশ্রম আমার কাছে কঠিন নয়। কারণটা মানসিক।” তবে ভারতীয় দলের বর্তমান প্রয়োজন এবং তাঁর ফিটনেস তাঁকে আবার জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাতে প্ররোচিত করেছে।
ভারতের এশিয়ান কাপ অভিযান
এএফসি এশিয়ান কাপ ২০২৭-এর বাছাইপর্বে ভারতকে বাংলাদেশ, হংকং (চীন) এবং সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একই গ্রুপে রাখা হয়েছে। এই মাসের শেষে শিলংয়ের জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে ভারত তাদের অভিযান শুরু করবে। গত এশিয়ান কাপে ভারতের প্রদর্শন ছিল হতাশাজনক—গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচেই হেরে তারা বিদায় নিয়েছিল। এবার সুনীলের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে ভারতীয় দল তৃতীয়বারের জন্য এশিয়ান কাপে জায়গা করে নেওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চায়।
কোচ মানোলো মার্কেজ সুনীলকে প্রথাগত নম্বর ৯ স্ট্রাইকার হিসেবে ব্যবহার করবেন, নাকি বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামাবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা ও গোল করার ক্ষমতা দলের জন্য বড় শক্তি হবে বলে সমর্থকরা আশাবাদী।
ভাইচুং ভূটিয়ার মন্তব্য
সম্প্রতি প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক ভাইচুং ভূটিয়া ভারতীয় ফুটবলে স্ট্রাইকারদের অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “কিছু ভারতীয় স্ট্রাইকার ও আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার দারুণ মুহূর্ত উপহার দিয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। সুনীল ছেত্রীর পর কোনো খেলোয়াড় ভারতীয় ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটা আমরা বলতে পারিনি। এই বছরের সর্বোচ্চ ভারতীয় গোলদাতাও ৪০ বছরের সুনীল ছেত্রী। ফাঁকটা বড়, তবে আশা করি ২০২৫ সালে আমরা নতুন প্রতিভা দেখতে পাব।” ভূটিয়ার এই মন্তব্য ভারতীয় ফুটবলে নতুন প্রজন্মের স্ট্রাইকার তৈরির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।
বেঙ্গালুরুতে সুনীলের পারফরম্যান্স
আইএসএল-এ বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে সুনীলের পারফরম্যান্স এই মরশুমে চোখ ধাঁধানো। গত মরশুমে দলটি লিগে তৃতীয় থেকে নিচে শেষ করলেও, এবার সুনীলের নেতৃত্বে তারা প্লে-অফে ফিরেছে। গোল্ডেন বুটের দৌড়ে তিনি দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। তাঁর ফিটনেস ও গোল করার ক্ষমতা দেখে সমর্থকরা আশা করছেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তিনি একই জাদু দেখাবেন।
ভারতীয় ফুটবলের জন্য সুনীলের গুরুত্ব
সুনীল ছেত্রী শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি ভারতীয় ফুটবলের একটি প্রতীক। তাঁর ৯৪টি আন্তর্জাতিক গোল এবং দীর্ঘ ক্যারিয়ার তাঁকে সমসাময়িক ফুটবলারদের মধ্যে আলাদা করে তুলেছে। তিনি যখন অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভারতীয় ফুটবল সমর্থকদের মনে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। তবে তাঁর প্রত্যাবর্তন ভক্তদের মধ্যে নতুন উৎসাহ জাগিয়েছে।
ভারতীয় ফুটবল দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য লড়ছে। সুনীলের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের ফিরে আসা দলের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। তিনি এশিয়ান কাপে তৃতীয়বারের জন্য ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে চান, এবং তাঁর এই লক্ষ্য পূরণে সমর্থকরা তাঁর পাশে রয়েছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারতের বাছাইপর্বের গ্রুপে বাংলাদেশ, হংকং এবং সিঙ্গাপুরের মতো দলগুলো রয়েছে। এই দলগুলোর বিরুদ্ধে জয় পাওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব, যদি তারা সঠিক কৌশল ও প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামে। সুনীলের অভিজ্ঞতা এবং তরুণ খেলোয়াড়দের উদ্যম মিলিয়ে ভারত যদি গ্রুপ পর্বে ভালো ফল করে, তবে এশিয়ান কাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।
সুনীল ছেত্রীর অবসর ভেঙে ফিরে আসা ভারতীয় ফুটবলের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি। তাঁর গোল করার ক্ষমতা, নেতৃত্ব এবং অভিজ্ঞতা দলকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। মার্চে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচগুলোতে তিনি কীভাবে পারফর্ম করেন, তা দেখার জন্য সমর্থকরা মুখিয়ে রয়েছেন। ভারতীয় ফুটবলের এই কিংবদন্তির প্রত্যাবর্তন যেন ২০২৫ সালে নতুন সাফল্যের গল্প লেখে, সেই প্রত্যাশা রাখাই যায়।