ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যাঁদের বলা যায় ‘ময়দানের নায়ক’। মাঠে তাঁদের উপস্থিতি ছিল এক আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, আর খেলার ধারায় তাঁদের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। তেমনই এক নাম প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (Prasanta Banerjee)। কলকাতা ময়দানের প্রথম ‘এক লাখি’ ফুটবলার। দীর্ঘ ফুটবল জীবনের বহু অজানা অধ্যায় এবার ধরা পড়েছে তাঁর সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘মাঝমাঠের রাজপাটে’।
১৯৭০ ও ৮০ দশকের কলকাতা লিগ, ফুটবলের ডার্বি যুদ্ধ, মাঠের উত্তেজনা আর গ্যালারির উন্মাদনার সাক্ষী ছিলেন প্রশান্ত। তিনি ছিলেন এমন এক মিডফিল্ডার, যিনি নিজের খেলায় শুধু কোচ বা সহখেলোয়াড়দের মন জয় করেননি, দর্শকদেরও বানিয়ে তুলেছিলেন তাঁর ভক্ত। আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁর খেলা দেখার সুযোগ পাননি, তবে ‘মাঝমাঠের রাজপাট’র পাতা উল্টোলেই যেন ফিরে যাওয়া যায় সেই সময়ে, যখন ময়দানের ফুটবল ছিল শহরের হৃদস্পন্দন।
প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি আলোচনায় আসে তখনই, যখন কলকাতা ময়দানে ফুটবলারের দাম নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে শহর। তিনিই ছিলেন প্রথম যাঁর জন্য ক্লাব এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়। সেই সময়ের অর্থনীতির প্রেক্ষিতে এই অঙ্ক ছিল অভাবনীয়। শুধু পারিশ্রমিক নয়, মাঠের পারফরম্যান্স দিয়েও তিনি প্রমাণ করেছিলেন, কেন তিনি সেই অঙ্কের যোগ্য।
১৯৭৬ সালের ডার্বি ম্যাচ—প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আজও স্মরণীয়। আকবরের ১৭ সেকেন্ডের গোলে মোহনবাগান জিতে গেলেও, প্রশান্তের পারফরম্যান্স ছাপ ফেলে দিয়েছিল সমর্থকদের মনে। সেই ম্যাচে তিনি ছিলেন ইস্টবেঙ্গল শিবিরে। ম্যাচ শেষে চুনী গোস্বামীর মতো কিংবদন্তির কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সহজ কথা নয়। ইডেন গার্ডেন্স থেকে ইস্টবেঙ্গল মাঠ পর্যন্ত সমর্থকদের কাঁধে চড়ে যাওয়াটাই বলে দেয়, তিনি সেই ম্যাচে কেমন খেলেছিলেন।
‘মাঝমাঠের রাজপাট’ শুধুমাত্র আত্মজীবনী নয়, এটি এক যুগের ফুটবল ইতিহাস। বইটি পাঠককে নিয়ে যায় ১৯৭০-৮০ দশকের কলকাতা ময়দানে। মাঠের বাইরে দলবদলের নাটক, কোচের কৌশল, ড্রেসিংরুমের গল্প—সবই আছে এই বইয়ে। ফুটবল প্রেমীদের কাছে এই বই এক রত্নভাণ্ডার। বইটির অনুলেখক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন ফুটবলার প্রশান্তের জীবনের নানা অধ্যায়। বইটি প্রকাশ করেছে দীপ প্রকাশন।
বই প্রকাশের অনুষ্ঠানও ছিল যথেষ্ট আড়ম্বরপূর্ণ। বাইপাসের ধারে এক বিলাসবহুল হোটেলে এই আত্মজীবনীর মোড়ক উন্মোচন করেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস-সহ ক্রীড়া জগতের আরও অনেকে। তাঁদের উপস্থিতিই বুঝিয়ে দেয় প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল ফুটবল জগতের নয়, ক্রীড়া জগতেরই এক মহারথী।
প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় খেলা ছাড়ার পর কোচিংয়ের দায়িত্বে থেকেছেন বহু ক্লাবে। তাঁর অভিজ্ঞতা, দর্শন ও জীবনদর্শন—সব মিলিয়ে তাঁর এই আত্মজীবনী শুধু একটি খেলোয়াড়ের কাহিনি নয়, বরং কলকাতা ময়দানের এক অনন্য দলিল।
আজকের প্রজন্মের ফুটবল প্রেমীদের জন্য এই বই শুধু অতীত জানার জানালা নয়, এক অনুপ্রেরণাও বটে। যখন আমরা অতীতে ফিরে তাকাই, বুঝি—একজন খেলোয়াড় কেবল মাঠে নয়, হৃদয়ে কীভাবে জায়গা করে নেন। প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক তেমনই এক নাম, যিনি আজও ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে রাজত্ব করেন। ‘মাঝমাঠের রাজপাট’ তাঁর সেই রাজত্বেরই গল্প।