ভারতীয় ক্রিকেট দলের জন্য ২০২৫ সালটা যেন একের পর এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুর্দান্ত জয়ের পর এবার সবার নজর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আসন্ন টেস্ট সিরিজের (India vs England) দিকে। এই সিরিজে ভারতীয় দলের কৌশল কী হবে, কোন খেলোয়াড়রা মাঠে নামবেন—এই নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। এরই মধ্যে প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার তথা ধারাভাষ্যকার নবজোৎ সিং সিধু একটি চমকপ্রদ প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “মিস্ট্রি স্পিনাররা ইংল্যান্ডের দুর্বলতা। এটা তাদের জন্য একটা ফোলা স্নায়ু। বরুণ চক্রবর্তীকে বাদ দেবেন? না, তাকে খেলাতেই হবে।” সিধুর এই মন্তব্য ক্রিকেট মহলে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে।
বরুণ চক্রবর্তী—এই নামটি এখন ভারতীয় ক্রিকেটে একটি পরিচিত মুখ। তবে টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্য। ৩৩ বছর বয়সী এই তামিলনাড়ুর স্পিনার সাদা বলের ক্রিকেটে, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি এবং ওডিআই ফরম্যাটে, নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিনি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছেন, ৯ উইকেট নিয়ে। তার মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ৫ উইকেটের অসাধারণ প্রদর্শনী তাকে আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে। তবে টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিজ্ঞতা মাত্র একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে সীমাবদ্ধ। ২০১৮ সালে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন, যেখানে তিনি ১০৫ রান দিয়ে মাত্র একটি উইকেট পেয়েছিলেন। তাহলে কি সিধু এমন একজন খেলোয়াড়ের উপর ভরসা রাখতে বলছেন, যিনি লাল বলের ক্রিকেটে প্রায় অপরীক্ষিত?
বরুণের শক্তি তার মিস্ট্রি স্পিনে। তিনি লেগ-স্পিনার হলেও তার বোলিংয়ে গুগলি, ওভারস্পিন এবং গতির তারতম্য ব্যাটারদের জন্য ধাঁধা তৈরি করে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি সিরিজে তিনি ১৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। হ্যারি ব্রুক, লিয়াম লিভিংস্টোনের মতো তারকা ব্যাটাররা তার বোলিংয়ের সামনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। এই পারফরম্যান্সই সিধুকে উৎসাহিত করেছে টেস্ট সিরিজে বরুণকে সুযোগ দেওয়ার কথা বলতে।
নবজোৎ সিং সিধু তার ধারাভাষ্যে প্রায়ই কাব্যিক উক্তি ব্যবহার করেন। এবারও তিনি বলেছেন, “ইংল্যান্ডের জন্য মিস্ট্রি স্পিনার একটা ফোলা স্নায়ু।” তিনি মনে করেন, ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা ঐতিহ্যগতভাবে স্পিনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। গত কয়েক বছরে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে তাদের এই দুর্বলতা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। রবিচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা এবং কুলদীপ যাদবের মতো স্পিনাররা ইংলিশ ব্যাটারদের নাকানিচোবানি দিয়েছেন। সিধুর যুক্তি, বরুণ চক্রবর্তী এই তালিকায় নতুন সংযোজন হতে পারেন। তিনি বলেন, “বরুণকে বাদ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তাকে খেলাতে হবে। নইলে কুলদীপ যাদবের উচ্চমানের ডেলিভারি দিয়েও ইংলিশদের পড়তে অসুবিধা হবে।”
ইংল্যান্ডের বর্তমান দল, বেন স্টোকসের নেতৃত্বে, আক্রমণাত্মক ‘বাজবল’ ক্রিকেট খেললেও স্পিনের বিরুদ্ধে তাদের দুর্বলতা লুকোনো নেই। হ্যারি ব্রুকের মতো তরুণ প্রতিভা থাকলেও, বরুণের মতো মিস্ট্রি স্পিনারদের বোঝা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সিধু মনে করেন, ভারত যদি ইংল্যান্ডের মাটিতে জয়ের স্বপ্ন দেখতে চায়, তাহলে বরুণের মতো অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করতেই হবে।
বরুণের টেস্ট দলে জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ভারতের বর্তমান টেস্ট দলে স্পিন বিভাগে রবীন্দ্র জাদেজা, অক্ষর প্যাটেল, ওয়াশিংটন সুন্দর এবং কুলদীপ যাদবের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড় রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে বরুণকে সুযোগ দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত? ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, টেস্ট ফরম্যাটে ধারাবাহিকতা এবং অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। বরুণের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সীমিত অভিজ্ঞতা তার জন্য বড় বাধা হতে পারে। তবে অন্যদিকে, তার সাম্প্রতিক ফর্ম এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাফল্য তাকে একটি ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ হিসেবে বিবেচনা করার যুক্তি দেয়।
ভারতীয় দলের প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীর, যিনি বরুণকে টি-টোয়েন্টি এবং ওডিআই ফরম্যাটে পুনরায় দলে ফিরিয়ে এনেছেন, তার উপর ভরসা রেখেছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য বরুণের শেষ মুহূর্তে দলে অন্তর্ভুক্তি গম্ভীরের কৌশলগত চিন্তাভাবনার প্রমাণ। সিধু মনে করেন, গম্ভীরের এই সাহসিকতা টেস্টেও প্রয়োগ করা উচিত। তিনি বলেন, “আইপিএল চলাকালীন হলেও দলের সেরা একাদশ নির্বাচন করতে হবে। বরুণকে খেলানো একটি কৌশলগত জয় হতে পারে।”
ভারতের জন্য ২০২৫ সালের টেস্ট মরশুম কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে হার এবং নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাজয়ের পর দলটি ধারাবাহিকতার খোঁজে রয়েছে। ইংল্যান্ড সিরিজে জয় ভারতের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলির মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের ফর্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে বরুণের মতো নতুন মুখ দলে নতুন শক্তি যোগ করতে পারে।
বরুণকে টেস্ট দলে দেখতে চাওয়ার দাবি ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে সিধুর মতের সমর্থন করেছেন। একজন সমর্থক লিখেছেন, “ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বরুণের মিস্ট্রি স্পিন আমাদের জয়ের চাবিকাঠি হতে পারে।” তবে কেউ কেউ সতর্ক করে বলেছেন, “টেস্ট ক্রিকেট আলাদা খেলা। বরুণের জন্য এটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে।”
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ শুরু হবে জুন মাসে। তার আগে ভারতীয় দল কীভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে, কোন কৌশল নিয়ে মাঠে নামে—সেটাই এখন দেখার। নবজোৎ সিং সিধুর প্রস্তাব বিতর্কের জন্ম দিলেও, এটা স্পষ্ট যে বরুণ চক্রবর্তী ভারতীয় ক্রিকেটে একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা। তাকে টেস্ট দলে দেখা যাবে কি না, সেটা সময়ই বলবে। তবে সিধুর কথায় যদি সত্যি থাকে, তাহলে ইংল্যান্ডের ব্যাটারদের জন্য বরুণের মিস্ট্রি স্পিন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।