১৩৪তম বর্ষে পদার্পণ করেছে এশিয়ার প্রাচীনতম ফুটবল টুর্নামেন্ট ডুরান্ড কাপ (Durand Cup 2025)। ভারতের ফুটবল ইতিহাসে যার গৌরবময় অবস্থান, সেই ঐতিহ্যবাহী আসরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে কলকাতার (Kolkata Football) তিন প্রধান ক্লাব মোহনবাগান (Mohun Bagan), ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) ও মহামেডান (Mohammedan SC) স্পোর্টিং ক্লাব।
স্বাধীনতার আগে শুরু সাফল্যের পথচলা
১৯১১তে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয় যতটা আবেগের প্রতীক। ১৯৪০ সালে মহামেডান স্পোর্টিংয়ের ডুরান্ড কাপ জয় ততটাই সাহসিকতার নিদর্শন। তখন ব্রিটিশ সেনা দলের আধিপত্যে থাকা এই টুর্নামেন্টে রয়্যাল ওয়ারউইকশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে দেশের প্রথম স্বাধীনচেতা ক্লাব হিসেবে ডুরান্ড কাপ ঘরে তোলে সাদা-কালো জায়ান্টরা। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই জয় ছিল দেশের খেলাধুলা জগতে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
১৯২৫ সালে, মোহনবাগান ক্লাব হয় প্রথম অসামরিক দল যাদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সম্মানজনকভাবে আমন্ত্রণ জানায় ডুরান্ডে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছলেও ফাইনালে ওঠা হয়নি। তবু শুরু হয়েছিল কলকাতার ক্লাবগুলির ডুরান্ডে জয়ের অভিযান।
স্বাধীনতার পর আধিপত্য মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের
স্বাধীনতার পর ডুরান্ড কাপ হয়ে ওঠে ভারতের জাতীয় ফুটবল মরসুমের অন্যতম মুখ্য টুর্নামেন্ট। এই সময়েই মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল নিজেদের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে। ইস্টবেঙ্গল প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৫১ সালে। টানা দু’বার তারা খেতাব ধরে রাখে। অন্যদিকে, মোহনবাগান প্রথমবার শিরোপা জেতে ১৯৫৩ সালে। দুই ক্লাবই পরবর্তী কয়েক দশকে ডুরান্ড কাপ জয়ের হ্যাটট্রিক করে। মোহনবাগান দু’বার, ইস্টবেঙ্গল একবার।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঐতিহাসিক ফাইনাল
ডুরান্ড কাপ মানেই কলকাতা ডার্বি। বহুবার এই ডার্বি হয়েছে ফাইনালে। ১৯৬০ প্রথমবার দুই ক্লাব যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়, কারণ ম্যাচের কোন ফলাফল নির্ধারিত হয়নি। ১৯৭০ সালে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে হারিয়ে জিতলে, ১৯৬৪ ও ২০২৩ সালে জয়ের হাসি হেসেছে মোহনবাগান।মহামেডান এসসিও পিছিয়ে নেই। ছয়বার ফাইনালে উঠে ১৯৪০ ও ২০১৩ সালে জিতেছে। ১৯৫৯ ও ১৯৮০ সালে ফাইনালে মোহনবাগানের কাছে হারে।
শহর ছাড়িয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের উত্থান
২০১৯ সালে ডুরান্ড কাপ স্থানান্তরিত হয় দিল্লি থেকে কলকাতায়। ২০২২ সাল থেকে টুর্নামেন্ট ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক শহরে। মণিপুর, মিজোরাম, মেঘালয়, ওডিশার মতো রাজ্যগুলি থেকে উঠে আসছে একঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলার। নাওরেম মহেশ, লালিয়ানজুয়ালা, সুরেশ সিং, উদান্ত সিং, বিপিন সিং এঁরা সবাই এই অঞ্চল থেকে উঠে আসা জাতীয় তারকা।
তবু, ডুরান্ড কাপে কলকাতার তিন প্রধানের জয়গাথা চিরকাল অবিস্মরণীয় থাকবে। মোহনবাগান ৩০ বার ফাইনালে উঠে ১৭ বার জিতেছে। ইস্টবেঙ্গল ২৭ বার ফাইনালে পৌঁছে ১৬ বার ট্রফি জিতেছে। তিন প্রধান মিলিয়ে প্রায় ৪০ বারেরও বেশি চ্যাম্পিয়নশিপ জয়, যা ভারতীয় ফুটবলে একটি অনন্য নজির।
কিংবদন্তি ফুটবলারের উত্থান
ডুরান্ড কাপে জন্ম নিয়েছেন বহু কিংবদন্তি। ১৯৭৬ সালে মোহনবাগানের উলগানাথন প্রথম হ্যাটট্রিক করেন ফাইনালে। ১৯৯৩ সালে বিএসএফের বিরুদ্ধে বাইসাইকেল কিকে গোল করে আত্মপ্রকাশ করেন বাইচুং ভুটিয়া। ২০০২ সালের দিল্লির সিটি ক্লাবের হয়ে গোল করে জাতীয় মঞ্চে নিজের উপস্থিতি জানান সুনীল ছেত্রী।
বর্তমানে আইএসএল মরসুমের আগে ডুরান্ড কাপ হয়ে উঠেছে প্রস্তুতির আদর্শ মঞ্চ। তবে প্রস্তুতির বাইরেও, এই টুর্নামেন্ট আজও নিজের ঐতিহ্য ও আভিজাত্য ধরে রেখেছে। কলকাতার তিন প্রধানের অংশগ্রহণেই টুর্নামেন্ট পায় প্রাণ। প্রতি বছর ডুরান্ড মানেই বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে নতুন আবেগ, পুরনো স্মৃতিচারণ এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনন।
Kolkata Football Clubs glory history in Durand Cup Mohun Bagan East Bengal Mohammedan SC success