ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষস্থানীয় নকআউট প্রতিযোগিতা কলিঙ্গ সুপার কাপ (Kalinga Super Cup ) , যা ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) এবং আই-লিগের দলগুলোর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়, ২০১৮ সালে ঐতিহাসিক ফেডারেশন কাপের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ) দ্বারা আয়োজিত এই প্রতিযোগিতাটি অংশগ্রহণকারী ক্লাবগুলোর জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। ফাইনালে জয়ী দলটি এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর জন্য যোগ্যতা অর্জন করে। ২০১৮ সাল থেকে মাত্র পাঁচজন কোচ এই কাপ জিতেছেন। নিচে কলিঙ্গ সুপার কাপের বিজয়ী কোচদের তালিকা দেওয়া হলো:
২০১৮ – আলবার্ট রোকা (বেঙ্গালুরু এফসি)
কলিঙ্গ সুপার কাপের প্রথম আসরে স্প্যানিশ কোচ আলবার্ট রোকা বেঙ্গালুরু এফসি-কে নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ জয় ছিনিয়ে আনেন। রোকার কৌশল ছিল গঠনমূলক এবং আক্রমণাত্মক ফুটবলের সমন্বয়। তিনি সুনীল ছেত্রী এবং মিকুর মতো তারকা খেলোয়াড়দের দিয়ে গতিশীল এবং আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলিয়েছেন। ফাইনালে তার দল ইস্ট বেঙ্গল এফসি-কে ৪-১ গোলে পরাজিত করে ভারতীয় ফুটবলের নতুন নকআউট প্রতিযোগিতায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। রোকার নেতৃত্বে বেঙ্গালুরু এফসি প্রথম আসরে শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে।
২০১৯ – সার্জিও লোবেরা (এফসি গোয়া)
২০১৯ সালে আরেক স্প্যানিশ কোচ সার্জিও লোবেরা এফসি গোয়াকে কলিঙ্গ সুপার কাপের শিরোপা এনে দেন। লোবেরা তার বল দখল-ভিত্তিক এবং উচ্চ-গতির খেলার ধরনের জন্য পরিচিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে এফসি গোয়া দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলেছে। এডু বেদিয়া এবং ফেরান কোরোমিনাসের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত দলটি ফাইনালে চেন্নাইয়িন এফসি-কে হারিয়ে তাদের প্রথম বড় শিরোপা জিতে নেয়। লোবেরার কৌশল এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে তার সমন্বয় দলটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল।
২০২৩ – ক্লিফোর্ড মিরান্ডা (ওড়িশা এফসি)
কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০২৩ সালে কলিঙ্গ সুপার কাপ ফিরে আসে। এই আসরে প্রথম ভারতীয় কোচ হিসেবে ক্লিফোর্ড মিরান্ডা ওড়িশা এফসি-কে তাদের প্রথম শিরোপা জিতিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। মৌসুমের মাঝপথে দায়িত্ব নেওয়া মিরান্ডা দলের মধ্যে ঐক্য এবং প্রেরণা নিয়ে আসেন। তার কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং খেলোয়াড়দের প্রতি তার প্রভাব শীর্ষ আইএসএল দলগুলোকে হারিয়ে শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিরান্ডার এই জয় ভারতীয় কোচদের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।
২০২৪ – কার্লেস কুয়াদ্রাত (ইস্ট বেঙ্গল এফসি)
২০২৪ সালে স্প্যানিশ কোচ কার্লেস কুয়াদ্রাত ইস্ট বেঙ্গল এফসি-র ১২ বছরের শিরোপা খরা শেষ করেন। তার পরিচ্ছন্ন প্রস্তুতি এবং শক্তিশালী রক্ষণাত্মক কৌশলের জন্য পরিচিত কুয়াদ্রাত ক্লেইটন সিলভা এবং নওরেম মহেশের মতো খেলোয়াড়দের সেরাটা বের করে আনেন। ফাইনালে ওড়িশা এফসি-র বিপক্ষে ৩-২ গোলে জয়ের মাধ্যমে ইস্ট বেঙ্গল তাদের প্রথম জাতীয় শিরোপা জিতে নেয়। কুয়াদ্রাতের নেতৃত্বে দলটি প্রতিটি ম্যাচে অসাধারণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে, যা তাদের সমর্থকদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছে।
২০২৫ – মানোলো মার্কেজ (এফসি গোয়া)
২০২৫ সালের আসরে এফসি গোয়া তাদের ইতিহাসে দ্বিতীয় কলিঙ্গ সুপার কাপ শিরোপা জিতে নেয়। স্প্যানিশ কোচ মানোলো মার্কেজ এই প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্প্যানিশ কোচ হিসেবে শিরোপা জয়ের গৌরব অর্জন করেন। তার বিস্তারিত প্রস্তুতি এবং শক্তিশালী রক্ষণাত্মক কাঠামোর জন্য পরিচিত মার্কেজ বোর্জা হেরেরা এবং ইকের গুয়ারোত্সেনার মতো খেলোয়াড়দের সেরা পারফরম্যান্স বের করে আনেন। ফাইনালে তার দল জামশেদপুর এফসি-কে পরাজিত করে শিরোপা জয় করে। এই জয় মার্কেজের এফসি গোয়ার সঙ্গে শেষ ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং তিনি এই জয়ের মাধ্যমে সমর্থকদের জন্য স্মরণীয় স্মৃতি রেখে গেছেন।
কলিঙ্গ সুপার কাপের গুরুত্ব
কলিঙ্গ সুপার কাপ শুধুমাত্র একটি শিরোপা প্রতিযোগিতা নয়, এটি ভারতীয় ফুটবলের ক্লাবগুলোর জন্য তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার একটি মঞ্চ। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী দল এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২-এর প্রাথমিক পর্যায়ে খেলার সুযোগ পায়, যা ক্লাব এবং কোচদের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শনের একটি বড় সুযোগ। ২০১৮ সাল থেকে এই প্রতিযোগিতায় স্প্যানিশ কোচদের আধিপত্য লক্ষণীয়। আলবার্ট রোকা, সার্জিও লোবেরা, কার্লেস কুয়াদ্রাত এবং মানোলো মার্কেজের সাফল্য প্রমাণ করে যে স্প্যানিশ কোচিং দর্শন ভারতীয় ফুটবলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তবে, ক্লিফোর্ড মিরান্ডার জয় ভারতীয় কোচদের সম্ভাবনাকেও তুলে ধরেছে, যা ভবিষ্যতে আরও স্থানীয় কোচদের উত্থানের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
কলিঙ্গ সুপার কাপ ভারতীয় ফুটবলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী কোচরা তাদের কৌশলগত দক্ষতা এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্লাবগুলির ইতিহাসে নিজেদের নাম অমর করে রেখেছেন। আলবার্ট রোকা, সার্জিও লোবেরা, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা, কার্লেস কুয়াদ্রাত এবং মানোলো মার্কেজের সাফল্য ভারতীয় ফুটবলের ক্রমবর্ধমান মান এবং প্রতিযোগিতার তীব্রতার প্রমাণ। ভবিষ্যতে এই তালিকায় আরও নতুন নাম যুক্ত হবে বলে সমর্থকরা আশাবাদী। কলিঙ্গ সুপার কাপের পরবর্তী আসরে কোন কোচ তার দলকে শিরোপা জিতিয়ে ইতিহাসে নাম লেখাবেন, তা দেখার জন্য ফুটবলপ্রেমীরা মুখিয়ে আছে।