ফুটবল ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় লেখা হয়েছে। ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপে (FIFA World Cup 2026) প্রথম অ-আয়োজক দেশ হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেছে জাপান। ফিফার ছয়টি কনফেডারেশন—এএফসি (এশিয়া), সিএএফ (আফ্রিকা), কনকাকাফ (উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান), কনমেবল (দক্ষিণ আমেরিকা), ওএফসি (ওশেনিয়া) এবং ইউইএফএ (ইউরোপ)—নিজ নিজ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্ধারণ করে। এই প্রক্রিয়াগুলোর সময়সীমা ভিন্ন হলেও, এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) থেকে প্রথম দল হিসেবে জাপান যোগ্যতা অর্জন করেছে। তৃতীয় রাউন্ডের বাছাই পর্বে জাপান তাদের গ্রুপে ছয়টি জয় এবং একটি ড্রয়ের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে বাহরাইনের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে জয়ের মাধ্যমে গাণিতিকভাবে তাদের স্থান নিশ্চিত করেছে।
Also Read | মনোলোর হাত ধরে জাতীয় দলে অভিষেক তিন তরুণ তুর্কির
এবারের বিশ্বকাপে আয়োজক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ্যতা পেয়েছে। ফলে অফিসিয়াল দলের সংখ্যা তিন থেকে বেড়ে চার হয়েছে। ২০২৬ সালের বিশ্বকাপটি ফিফার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আসর হতে চলেছে। পূর্ববর্তী ৩২টি দলের পরিবর্তে এবার ৪৮টি দল অংশ নেবে। ফিফার হিসেব অনুযায়ী, এই ১০৪ ম্যাচের টুর্নামেন্টে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ লক্ষেরও বেশি ফুটবলপ্রেমী উত্তর আমেরিকায় সমবেত হবেন। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো এবং কানাডায় কোথায় কোথায় ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হবে, তার বিস্তারিত আমরা এখানে আলোচনা করেছি।
জাপানের যোগ্যতা অর্জনের পথ
জাপানের এই সাফল্য এশিয়ান ফুটবলের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রমাণ। সাইতামা স্টেডিয়ামে বাহরাইনের বিরুদ্ধে ম্যাচে জাপানের হয়ে গোল করেন দাইচি কামাদা এবং তাকেফুসা কুবো। এই জয়ের মাধ্যমে জাপান তাদের গ্রুপে শীর্ষস্থান ধরে রেখে টানা অষ্টমবারের মতো বিশ্বকাপে প্রবেশ নিশ্চিত করেছে। এএফসি-র তৃতীয় রাউন্ডে গ্রুপ সি-তে জাপানের পয়েন্ট এখন ১৯। দ্বিতীয় স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট ১০ এবং তৃতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরবের পয়েন্ট ৬। এখনও তিনটি ম্যাচ বাকি থাকলেও জাপানের যোগ্যতা গাণিতিকভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে।
জাপানের ফুটবল দল গত দুটি বিশ্বকাপে শেষ ষোলোতে পৌঁছেছে। ১৯৯৮ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার পর, ২০০২ সালে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল। এবারের বাছাই পর্বে জাপান অপরাজিত থেকে ১৪টি গোল করেছে এবং তিনটি ক্লিন শিট রেখেছে। জাপানের কোচ হাজিমে মোরিয়াসু বলেন, “আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করেছি। এখন আমাদের ফোকাস বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্সের দিকে।” জাপানের এই সাফল্য এশিয়ার অন্য দলগুলোর জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।
২০২৬ বিশ্বকাপের গঠন
২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপে ৪৮টি দল অংশ নেবে। অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিম্নলিখিত কনফেডারেশন থেকে আসবে:
• এএফসি (এশিয়া): ৮টি দল (জাপান ইতিমধ্যে যোগ্যতা অর্জন করেছে)
• সিএএফ (আফ্রিকা): ৯টি দল
• কনকাকাফ (উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান): যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা + ৩টি দল
• কনমেবল (দক্ষিণ আমেরিকা): ৬টি দল
• ওএফসি (ওশেনিয়া): ১টি দল
• ইউইএফএ (ইউরোপ): ১৬টি দল
• ইন্টার-কনফেডারেশন প্লে-অফ: ২টি দল
ইন্টার-কনফেডারেশন প্লে-অফে ছয়টি দল অংশ নেবে। এএফসি, সিএএফ, কনমেবল এবং ওএফসি থেকে একটি করে দল এবং কনকাকাফ থেকে দুটি দল এই প্লে-অফে লড়বে। এই ছয় দলের মধ্যে থেকে দুটি দল বিশ্বকাপের শেষ দুটি স্থান পাবে। ইউইএফএ এই প্লে-অফে অংশ নেবে না।
বাছাই প্রক্রিয়ার সময়সূচি
৪৮টি দলের মধ্যে ৪২টি দল ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ নির্ধারিত হবে। প্রতিটি কনফেডারেশনের বাছাই প্রক্রিয়ার সময়সূচি নিম্নরূপ:
• এএফসি (এশিয়া): পরবর্তী বাছাই ম্যাচগুলো মার্চের শেষে। প্রক্রিয়া শেষ হবে নভেম্বরের মাঝামাঝি।
• সিএএফ (আফ্রিকা): পরবর্তী ম্যাচ মার্চের শেষে। প্রক্রিয়া শেষ নভেম্বরের মাঝামাঝি।
• কনকাকাফ: যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ্যতা পেয়েছে। পরবর্তী ম্যাচ জুনের শুরুতে। শেষ তিনটি স্থান নভেম্বরের মাঝামাঝি নির্ধারিত হবে।
• কনমেবল (দক্ষিণ আমেরিকা): পরবর্তী ম্যাচ মার্চের শেষে। প্রক্রিয়া শেষ সেপ্টেম্বরে।
• ওএফসি (ওশেনিয়া): প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে ২৪ মার্চ।
• ইউইএফএ (ইউরোপ): পরবর্তী ম্যাচ মার্চের শেষে। প্রক্রিয়া শেষ হবে ২০২৬ সালের মার্চে (শেষ চারটি স্থানের প্লে-অফ), বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক মাস আগে।
• ইন্টার-কনফেডারেশন প্লে-অফ: ২০২৬ সালের মার্চে শেষ দুটি স্থানের জন্য ছয়টি দল লড়বে।
জাপানের সাফল্যের তাৎপর্য
জাপানের এই যোগ্যতা অর্জন এশিয়ান ফুটবলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এএফসি-র জন্য বরাদ্দকৃত ৮টি স্থানের মধ্যে জাপান প্রথম দল হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করেছে। বাকি সাতটি স্থানের জন্য অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরানের মতো দলগুলো প্রতিযোগিতায় রয়েছে। জাপানের এই প্রাথমিক সাফল্য অন্য দলগুলোর জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
জাপানের ফুটবলের উত্থান গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ এবং ২০২২ বিশ্বকাপে তারা শক্তিশালী দলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ২০২২ সালে তারা জার্মানি এবং স্পেনের মতো দলকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। এবারের বিশ্বকাপে তারা আরও বড় লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামবে।
বিশ্বকাপের প্রভাব
২০২৬ সালের বিশ্বকাপ উত্তর আমেরিকার জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ১১টি শহরে ৭৮টি ম্যাচ, মেক্সিকোতে তিনটি শহরে ১৩টি ম্যাচ এবং কানাডায় দুটি শহরে ১৩টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। ফাইনাল ম্যাচটি নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ১৯ জুলাই ২০২৬-এ হবে। এই টুর্নামেন্ট অর্থনীতি, পর্যটন এবং ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিশ্বকাপের এই সম্প্রসারণ ফুটবলের বিশ্বায়নের একটি পদক্ষেপ। আফ্রিকা এবং এশিয়ার মতো অঞ্চলগুলোর জন্য বাড়তি স্থান তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগ দেবে। তবে, ৪৮টি দলের টুর্নামেন্টে প্রতিযোগিতার মান বজায় রাখা ফিফার জন্য চ্যালেঞ্জ হবে।
জাপানের যোগ্যতা অর্জন ২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের পথে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। প্রথম অ-আয়োজক দেশ হিসেবে তারা এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবে। আগামী মাসগুলোতে বাকি ৪৪টি দল নির্ধারিত হবে। এই বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে, যেখানে জাপানের মতো দলগুলো তাদের শক্তি প্রমাণের সুযোগ পাবে। ফুটবলপ্রেমীরা এখন অপেক্ষায় রয়েছে এই মেগা ইভেন্টের জন্য, যা ২০২৬ সালে উত্তর আমেরিকায় শুরু হবে।