শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের জন্য আশার আলো দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন

ভারতের ক্রিকেট মাঠে প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার কোনো কমতি নেই। কিন্তু এই মাঠে এমন কিছু ক্রিকেটার রয়েছেন, যাঁরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে স্বপ্নপূরণের…

Inspiring Journey of West Bengal Divyang Cricket Association and Its Brave Players

ভারতের ক্রিকেট মাঠে প্রতিভা ও জনপ্রিয়তার কোনো কমতি নেই। কিন্তু এই মাঠে এমন কিছু ক্রিকেটার রয়েছেন, যাঁরা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’ (Divyang Cricket Association)-এর ক্রিকেটাররা। এই সংগঠনটি বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের জন্য একটি আলোর পথ দেখিয়েছে, যেখানে তাঁরা তাঁদের প্রতিভা ও আবেগকে মাঠে প্রকাশ করতে পারেন। এই প্রতিবেদনে আমরা তাঁদের সংগ্রাম, প্রশিক্ষণ এবং সাফল্যের গল্প তুলে ধরব।

অভিজিৎ বিশ্বাসের স্বপ্নের শুরু
ওয়েস্ট বেঙ্গল দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের পিছনে রয়েছে অভিজিৎ বিশ্বাস নামে একজন ক্রিকেটপ্রেমীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তিন বছর বয়সে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর হাতে আঘাত লাগে, যার ফলে তাঁর বাঁ হাতের আঙুল পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তবুও ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তাঁকে থামায়নি। ১৫ বছর ধরে ক্রিকেট খেলে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম বিভাগের ক্লাবে এবং আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়েছেন। তাঁর এই যাত্রায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর মতো আরও অনেক বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটার রয়েছেন, যাঁরা মাঠে খেলার সুযোগ চান কিন্তু আর্থিক ও শারীরিক বাধার কারণে পিছিয়ে পড়েন।

   

এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য অভিজিৎ ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ওয়েস্ট বেঙ্গল দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। তাঁর লক্ষ্য ছিল রাজ্যের প্রত্যেক কোণ থেকে প্রতিভাবান বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করা এবং তাঁদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। অভিজিৎ বলেন, “শুধু বিশেষভাবে সক্ষম হলেই চলবে না, তাঁদের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি ও প্রতিভা থাকতে হবে। নিজেদের পিছিয়ে পড়া ভাবলে চলবে না।” তিনি আরও জানান, সরকারি সহায়তা পেলে এই সংগঠন আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারবে।

প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ
WBDCA বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা কেবল ক্রিকেটের দক্ষতাই শিখছেন না, বরং তাঁদের আত্মবিশ্বাস ও দলগত কাজের মনোভাবও বাড়ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রিকেটাররা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিত্ব করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বাংলাদেশে দুটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন। এই সাফল্য তাঁদের প্রতিভা এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ।

অভিজিৎ এবং তাঁর দল ক্রিকেটারদের জন্য খাবার, থাকার ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণের সুবিধা প্রদান করেন। তবে, আর্থিক সংকট তাঁদের পথে বড় বাধা। উদাহরণস্বরূপ, লখনউতে একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য তাঁদের টিকিট, পোশাক এবং শীতের পোশাকের জন্য অর্থের প্রয়োজন। অভিজিৎ বলেন, “আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য টিকিট এবং পোশাকের ব্যবস্থা করতে অর্থের অভাব হচ্ছে। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি।”

সাফল্যের গল্প
WBDCA-র ক্রিকেটারদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের সাফল্যের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের নাম উজ্জ্বল করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় শারীরিক প্রতিবন্ধী টি-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে পশ্চিমবঙ্গ দিব্যাঙ্গ দল বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই টুর্নামেন্টে তাঁরা বিহার দিব্যাঙ্গ দলের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। এই ধরনের টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ তাঁদের প্রতিভা প্রদর্শনের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

Advertisements

অন্যদিকে, সুব্রত জোয়ার্দারের গল্পও অনুপ্রেরণাদায়ী। একটি বাইক দুর্ঘটনায় একটি পা হারানো সত্ত্বেও তিনি ভারতের দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হয়েছেন। তিনি কলকাতায় ‘স্ট্রেইট ড্রাইভ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা অন্ধ, বধির এবং শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ক্রিকেটারদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (CAB)-এর সমর্থনে এই অ্যাকাডেমি বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলেছে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আর্থিক সংকট এবং উপযুক্ত সুবিধার অভাব। অভিজিৎ এবং তাঁর দল প্রায়ই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য অর্থ সংগ্রহের সমস্যায় পড়েন। তবে, তাঁরা স্থানীয় সম্প্রদায়, দাতা এবং ক্রিকেট প্রেমীদের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছেন। এছাড়া, সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছ থেকে আরও সহায়তা পেলে এই সংগঠন আরও বড় পরিসরে কাজ করতে পারবে। অভিজিৎ বলেন, “আমরা চাই আমাদের ক্রিকেটাররা কেবল খেলার মাঠে নয়, জীবনেও জয়ী হোক।”

সমাজের প্রতি বার্তা
WBDCA-র গল্প শুধু ক্রিকেটের নয়, এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। এই সংগঠন প্রমাণ করে যে প্রতিবন্ধকতা কোনো স্বপ্নের পথে বাধা হতে পারে না। জেন জি তরুণদের মতো এই ক্রিকেটাররাও তাঁদের স্বাধীনতা ও পরিচয় তৈরি করছেন। তাঁদের সাফল্য আমাদের সবাইকে শেখায় যে, ইচ্ছাশক্তি এবং সঠিক সুযোগ থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা সম্ভব।

ওয়েস্ট বেঙ্গল দিব্যাঙ্গ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন বিশেষভাবে সক্ষম ক্রিকেটারদের জন্য একটি আশার আলো। অভিজিৎ বিশ্বাসের নেতৃত্বে এই সংগঠন প্রতিভাবান তরুণদের স্বপ্নপূরণের পথে সঙ্গী হয়েছে। তাঁদের প্রশিক্ষণ, সাফল্য এবং সংগ্রামের গল্প আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এই ক্রিকেটাররা প্রমাণ করেছেন যে, মাঠের সবুজ ঘাস শুধু তাঁদের ডাকে না, বরং তাঁদের জয়ের গল্পও লেখে। সরকারি ও সমাজের সমর্থন পেলে এই সংগঠন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারবে।