অবশেষে দীর্ঘ তিন বছরের আলোচনার পর ভারত ও যুক্তরাজ্য ২০২৫ সালের ২৪ জুলাই একটি ঐতিহাসিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (India UK FTA) স্বাক্ষর করল। এই চুক্তি ভারতের ইউরোপীয় অঞ্চলের সঙ্গে দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক চুক্তি (EFTA-র পর) এবং ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের চতুর্থ সম্পূর্ণ নতুন বাণিজ্যিক চুক্তি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ব্রিটিশ সমকক্ষ কিয়ার স্টারমার এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দুই দেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই চুক্তিতে পণ্য, পরিষেবা, বিনিয়োগ এবং মেধাস্বত্ব আইন (IPR)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে এবং বেশিরভাগ বিতর্কিত ইস্যু সমাধান করা হয়েছে।
চুক্তির দীর্ঘ পথচলা: টাইমলাইন এক নজরে:
- মে ২০২১: মোদী ও বরিস জনসন Enhanced Trade Partnership ঘোষণা করেন
- জানুয়ারি ২০২২: আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়
- জানুয়ারি–ডিসেম্বর ২০২২: প্রথম ৬ দফার আলোচনা ভার্চুয়াল, লন্ডন ও নয়াদিল্লিতে
- ফেব্রুয়ারি–আগস্ট ২০২৩: পরিষেবা, কর্মসংস্থান এবং হুইস্কির ওপর শুল্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্বক আলোচনা
- সেপ্টেম্বর–ডিসেম্বর ২০২৩: নির্বাচনের আগে আলোচনা ত্বরান্বিত হয়
- জানুয়ারি–মার্চ ২০২৪: সামাজিক নিরাপত্তা ও কার্বন ট্যাক্স নিয়ে অচলাবস্থা
- এপ্রিল ২০২৪: ভারতের নির্বাচন ও ব্রিটেনেও ভোটের কারণে আলোচনা স্থগিত
- জুন ২০২৪: মোদী পুনঃনির্বাচিত হন এবং ১০০ দিনের মধ্যে চুক্তি সম্পন্নের প্রতিশ্রুতি দেন
- জুলাই ২০২৪: স্টারমার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হন, চুক্তির দ্রুত সমাপ্তির পক্ষে মত দেন
- জানুয়ারি ২০২৫: আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় শুরু
- এপ্রিল ২০২৫: ৯০% বিষয় চূড়ান্ত
- মে ২০২৫: চূড়ান্ত ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি
- ২৪ জুলাই ২০২৫: আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়
কঠিন আলোচনার প্রেক্ষাপট:
২০২১ সালে বরিস জনসন ও মোদী যে Enhanced Trade Partnership ঘোষণা করেছিলেন, তা-ই এই চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও তখন জনসনের লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের দীপাবলির মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত করা, বাস্তবে তা বহুবার বিলম্বিত হয়।
বিভিন্ন ইস্যু যেমন – ভারতীয় পেশাদারদের ভিসা নীতি, যুক্তরাজ্যের কার্বন ট্যাক্স ছাড়, হুইস্কি ও ইলেকট্রিক গাড়িতে শুল্ক ইত্যাদি নিয়ে বারবার আলোচনা থেমে গেছে।
২০২৩ সালের শেষ ভাগ এবং ২০২৪ সালের প্রথম দিকে দুই দেশের নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় আলোচনার গতি আরও শ্লথ হয়ে পড়ে। ততদিনে ভারত EFTA-এর সঙ্গে আলাদা বাণিজ্য চুক্তি সই করে নেয়।
মূল ছাড় ও বিতর্কিত বিষয়গুলির নিষ্পত্তি:
২০২৪ সালের বসন্ত নাগাদ চুক্তির মোট ২৬টি অধ্যায়ের মধ্যে বেশিরভাগই সম্পূর্ণ হয়। তবুও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়ে যায় – যেমন ভারতের সামাজিক নিরাপত্তার চুক্তির দাবি এবং যুক্তরাজ্যের সরকারি ক্রয় ও আর্থিক পরিষেবা খাতে প্রবেশাধিকার চাওয়া।
৯ এপ্রিল ভারতীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং যুক্তরাজ্যের চ্যান্সেলর র্যাচেল রিভস জানান, মোট ৯০ শতাংশ চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে এবং দীর্ঘদিনের বিতর্কিত ভিসা ইস্যুতেও ঐক্যমত্য এসেছে।
শেষ পর্যন্ত মে মাসে মোদী ঘোষণা করেন যে ২৬টির মধ্যে ২৫টি বিষয়েই সমঝোতা হয়েছে এবং বাকি সমস্যাও দ্রুত সমাধান হবে।
মুক্ত বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্ত:
- এই চুক্তিকে দুই দেশই একটি “মাইলস্টোন” হিসেবে দেখছে। বিশেষভাবে উপকৃত হবে অ্যালকোহল খাত।
- Diageo India-র CEO হিনা নাগরাজন বলেন, “যদি স্কচ হুইস্কির ওপর ১৫০% আমদানি শুল্ক কমানো হয়, তবে এটি হবে গত কয়েক দশকে অ্যালকোহল শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় বাজারে প্রবেশাধিকারের সুযোগ।”
- চুক্তি স্বাক্ষরের পর এখন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। দুই দেশের পার্লামেন্টে বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে এবং শিল্প মহলও বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও সাপ্লাই চেইন নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নেবে।
কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক এক বড় সাফল্য:
ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর করতে এই FTA এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে এই চুক্তি যে বাস্তবায়িত হলো, তা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল।
দু’দেশের জন্যই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় — যেখানে কূটনৈতিক ধৈর্য, জটিল আলোচনার কৌশল এবং পারস্পরিক স্বার্থের সমন্বয় ঘটেছে এক ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে।