ভারত দীর্ঘদিন ধরে ২০৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক (India Olympics 2036) আয়োজনের স্বপ্ন দেখছে। গত বছর অক্টোবরে, ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (আইওএ) আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) ফিউচার হোস্ট কমিশনের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ পাঠিয়ে ২০৩৬ সালের অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক গেমস আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এবার একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, এই মেগা ক্রীড়া ইভেন্ট আয়োজনের জন্য ভারতের খরচ হতে পারে ৩৪,৭০০ কোটি টাকা থেকে ৬৪,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এই সপ্তাহে গান্ধীনগরে একটি উচ্চ-পর্যায়ের সমন্বয় কমিটির বৈঠকে ‘রিভিউ মিটিং – প্রিপেয়ার্ডনেস টুওয়ার্ডস আমদাবাদ ২০৩৬’ শীর্ষক একটি নথি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ভারতের এই অলিম্পিক আয়োজনের দৃঢ় সংকল্পকে পুনরায় নিশ্চিত করেছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া (টিওআই)-এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই নথিতে উল্লেখিত খরচ গত বছরের প্যারিস অলিম্পিকের (৩২,৭৬৫ কোটি টাকা) তুলনায় বেশি। “টিওআই-এর হাতে আসা চূড়ান্ত পরিকল্পনায় গুজরাতের যমজ শহর (আমদাবাদ ও গান্ধীনগর) এবং চারটি অন্যান্য শহর – ভোপাল, গোয়া, মুম্বই এবং পুনে -তে এই ক্রীড়া উৎসব আয়োজনের জন্য সম্ভাব্য খরচের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এটি পূর্ববর্তী অলিম্পিক সংস্করণগুলোর প্রেক্ষাপটে ব্যয়ের হিসেব তুলে ধরেছে,” রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
India Olympics 2036 খরচের বিভাজন ও পরিকল্পনা
ভারতের এই অলিম্পিক স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য খরচকে দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমটি হলো অলিম্পিক গেমসের আয়োজক কমিটির (ওসিওজি) বাজেট, যা প্রতিযোগিতা, কর্মীবাহিনী, থাকার ব্যবস্থা, প্রযুক্তি, পরিবহন এবং অস্থায়ী অবকাঠামোর মতো পরিচালন ব্যয় কভার করবে। এই বাজেটের পরিমাণ ১৮,৬০০ কোটি থেকে ৪১,১০০ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো নন-ওসিওজি বাজেট, যা ক্রীড়া ও অ-ক্রীড়া স্থানগুলোর জন্য মূলধন বিনিয়োগের উপর দৃষ্টি দেয়। এটি ১৬,১০০ কোটি থেকে ২২,৯০০ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, ৩০ শতাংশ অলিম্পিক ক্রীড়া বিদ্যমান স্থানগুলোতে অনুষ্ঠিত হবে, ৬০ শতাংশ নতুন পরিকল্পিত ক্রীড়া অবকাঠামোতে এবং ১০ শতাংশ অস্থায়ী সুবিধায়। আমদাবাদকে কেন্দ্র করে গুজরাতে সরদার বল্লভভাই প্যাটেল স্পোর্টস এনক্লেভ এবং করাই স্পোর্টস হাবকে প্রধান অলিম্পিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া, ভারতের অন্যান্য শহরগুলোতে বিভিন্ন ক্রীড়া আয়োজনের মাধ্যমে এটিকে একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
আইওসি প্রেসিডেন্টের মন্তব্য
সম্প্রতি নির্বাচিত আইওসি প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টি কভেন্ট্রি ভারতের ২০৩৬ অলিম্পিক আয়োজনের বিষয়ে সতর্ক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামী দিনগুলোতে ভবিষ্যৎ আয়োজক নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর “ধারণা” প্রকাশ করবেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট থমাস বাখ ২৩ জুন অলিম্পিক ডে-তে পদত্যাগের আগে ভারতের প্রস্তাব ‘অ্যাক্সিলারেটেড টার্গেটেড ডায়ালগ’-এ রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “দিনের শেষে একটি প্রক্রিয়া রয়েছে এবং সেটি চলমান। আমার জানা মতে, এটি আগামী কয়েক মাস ধরে চলবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমি মনে করি ভবিষ্যৎ আয়োজক নির্বাচনে সদস্যদের সম্পৃক্ত করা দরকার। আমার কিছু ধারণা আছে, হয়তো আগামী সপ্তাহে সেগুলো শেয়ার করব।”
কভেন্ট্রি ২৩ জুন থেকে আইওসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তিন মাসের ট্রানজিশন পিরিয়ডের পর।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রক্রিয়া
২০৩৬ অলিম্পিক আয়োজনের জন্য ১০টিরও বেশি দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে কাতার এবং সৌদি আরব উল্লেখযোগ্য। তবে কতগুলো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ‘লেটার অফ ইনটেন্ট’ জমা দেওয়ার মাধ্যমে ভারত ‘ইনফরমাল ডায়ালগ’ থেকে ‘কন্টিনিউয়াস ডায়ালগ’ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই পর্যায়ে আইওসি সম্ভাব্য আয়োজকের গেমস-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতির ‘সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন’ পরিচালনা করে।
পরবর্তী ধাপ হবে ‘টার্গেটেড ডায়ালগ’, যেখানে একটি সংস্করণ-নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব জমা দিতে হবে। এটি ফিউচার হোস্ট কমিশন দ্বারা মূল্যায়ন করা হবে। প্রক্রিয়াটি শেষ হবে হোস্ট নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০৩৬-এর আয়োজক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ২০২৬-এর আগে আসার সম্ভাবনা কম।
ভারতের প্রস্তুতি ও চ্যালেঞ্জ
ভারতের অলিম্পিক স্বপ্নের কেন্দ্রে রয়েছে আমদাবাদ। গুজরাত সরকার ইতিমধ্যে ৬,০০০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ক্রীড়া অবকাঠামো প্রকল্পে কাজ শুরু করেছে। সরদার বল্লভভাই প্যাটেল স্পোর্টস এনক্লেভে ছয়টি স্টেডিয়াম নির্মাণ চলছে, যার মোট আসন ক্ষমতা ৮০,০০০। এছাড়া, নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৩ সালের অক্টোবরে মুম্বইয়ে আইওসি-র ১৪১তম অধিবেশনে ভারতের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ভারত ২০৩৬ সালে অলিম্পিক আয়োজনের জন্য কোনো কসরত বাকি রাখবে না। এটি ১৪০ কোটি ভারতীয়দের স্বপ্ন।” তবে, আইওএ-র অভ্যন্তরীণ কলহ এবং প্রশাসনিক সমস্যা এই স্বপ্নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সম্ভাবনা ও প্রতিযোগিতা
ভারতের পাশাপাশি কাতার ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো তাদের আর্থিক শক্তি ও অভিজ্ঞতার জোরে এই দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে। কাতার ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের সফল আয়োজনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নিজেদের শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে দাবি করছে। ভারতের জন্য এই অলিম্পিক আয়োজন শুধু ক্রীড়া উৎসব নয়, বরং বিশ্ব মঞ্চে দেশের ক্ষমতা ও উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। তবে, এই স্বপ্ন পূরণে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অবকাঠামোগত প্রস্তুতির বিষয়ে আরও স্পষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন।
২০৩৬ অলিম্পিক ভারতের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। আমদাবাদ-কেন্দ্রিক এই পরিকল্পনা সফল হলে, এটি দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করবে। তবে, আগামী দিনে আইওসি-র সিদ্ধান্ত এবং ভারতের প্রস্তুতি এই স্বপ্নের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।