আই লিগে বিতর্ক! দুই দলই নিজেকে চ্যাম্পিয়ন দাবি করছে

ফুটবলের জগতে শেষ ম্যাচের সপ্তাহ সবসময়ই উত্তেজনা ও নাটকীয়তায় ভরপুর। ভক্তরা তাদের প্রিয় দলের জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে গণনা করেন, সম্ভাব্য ফলাফলের হিসাব-নিকাশে মেতে ওঠেন। কিন্তু…

Inter Kashi,Churchill Brothers

ফুটবলের জগতে শেষ ম্যাচের সপ্তাহ সবসময়ই উত্তেজনা ও নাটকীয়তায় ভরপুর। ভক্তরা তাদের প্রিয় দলের জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে গণনা করেন, সম্ভাব্য ফলাফলের হিসাব-নিকাশে মেতে ওঠেন। কিন্তু আই-লিগ ২০২৪-২৫ (I-League 2024-25) মরসুমের সমাপ্তি এমন এক নাটকীয় মোড় নিয়েছে, যেখানে শিরোপা নির্ধারণ হচ্ছে না মাঠে, বরং আদালতের রায়ের অপেক্ষায়। চার্চিল ব্রাদার্স এবং ইন্টার কাশি—দুই দলই নিজেদের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে, কিন্তু অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) আপিল কমিটির সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে চূড়ান্ত ফলাফল। এই ঘটনা শুধু ভারতীয় ফুটবলের জন্যই নয়, বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসেও একটি বিরল নজির হয়ে থাকবে।

আই-লিগের শেষ ম্যাচের নাটকীয়তা

আই-লিগের এই মরসুমে শিরোপার দৌড়ে ছিল চারটি দল—চার্চিল ব্রাদার্স, ইন্টার কাশি, রিয়াল কাশ্মীর এবং গোকুলাম কেরালা। শেষ ম্যাচের দিনে চার্চিল ব্রাদার্স রিয়াল কাশ্মীরের বিরুদ্ধে ১-১ গোলে ড্র করে ৪০ পয়েন্ট নিয়ে সাময়িকভাবে শীর্ষে থাকে। অন্যদিকে, ইন্টার কাশি রাজস্থান ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে ইনজুরি টাইমে দুটি গোল করে ৩-১ গোলে জয়লাভ করে ৩৯ পয়েন্ট অর্জন করে। তবে, ইন্টার কাশির শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা এখন নির্ভর করছে গত ১৩ জানুয়ারি নামধারি এফসির বিরুদ্ধে তাদের ০-২ গোলে হারের ম্যাচের উপর। ইন্টার কাশি দাবি করেছিল, নামধারি অযোগ্য খেলোয়াড় ক্লেডসন কার্ভালহো ডি সিলভা (ডেগোল) মাঠে নামিয়েছিল, যিনি চারটি হলুদ কার্ডের জন্য সাসপেনশনে থাকার কথা ছিল। এআইএফএফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি প্রথমে ইন্টার কাশির পক্ষে রায় দিয়ে ম্যাচের ফল ৩-০ করে দেয়, যা তাদের ৪২ পয়েন্টে নিয়ে যেত। কিন্তু নামধারি আপিল করলে মার্চ মাসে এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। এখন এআইএফএফ আপিল কমিটি ১২ এপ্রিল এই বিষয়ে শুনানি করবে, যা শিরোপার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।

মাঠের বাইরে শিরোপা নির্ধারণের ইতিহাস

বিশ্ব ফুটবলে এমন ঘটনা নতুন নয়, যেখানে মাঠের ফলাফলের পরিবর্তে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা আইনি লড়াই শিরোপা নির্ধারণ করেছে। এই ধরনের ঘটনা ফুটবলের চেতনার বিরুদ্ধে গেলেও, এগুলোই খেলাটির নাটকীয়তা বাড়ায়। আই-লিগের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয় কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।

১. রিয়াল মাদ্রিদের কোপা দেল রে বহিষ্কার (২০১৫)
২০১৫ সালে স্পেনের কোপা দেল রে-তে রিয়াল মাদ্রিদ একটি বড় ভুল করে। কাদিজের বিরুদ্ধে রাউন্ড অফ ৩২-এর ম্যাচে তারা ডেনিস চেরিশেভকে মাঠে নামায়, যিনি তার আগের ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে তিনটি হলুদ কার্ড পেয়ে সাসপেন্ডেড ছিলেন। চেরিশেভ শুধু খেলেনই নন, প্রথম গোলটিও করেন। ম্যাচটি ৩-১ গোলে জিতলেও, কাদিজের আপিলের পর রিয়াল মাদ্রিদকে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনা রিয়ালের জন্য লজ্জাজনক ছিল এবং তাদের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ভেঙে যায়।

২. এফসি সিওনের ইউরোপা লিগ বিতর্ক (২০১১)
২০১১ সালের ইউরোপা লিগে সুইস ক্লাব এফসি সিওন সেল্টিকের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলে জয় পায়। কিন্তু ২০০৮ সালে তারা অন্য ক্লাবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় এসাম এল হাদারিকে সই করায় ট্রান্সফার ব্যানের মুখে পড়ে। সেল্টিক দাবি করে, সিওন এই নিষেধাজ্ঞার সময়ে পাঁচজন অযোগ্য খেলোয়াড় মাঠে নামিয়েছিল। উয়েফা তদন্তের পর সিওনের বিরুদ্ধে ৩-০ গোলে পরাজয় ঘোষণা করে, ফলে তারা টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে।

৩. মার্সেইয়ের লিগ ওয়ান ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা হারানো (১৯৯৩)
১৯৯২-৯৩ মরসুমে ফ্রান্সের মার্সেই লিগ ওয়ান এবং উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করে। কিন্তু পরে জানা যায়, তারা ভ্যালেন্সিয়েন্সের বিরুদ্ধে ম্যাচে ঘুষ দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের খারাপ খেলতে প্ররোচিত করেছিল। আদালতের রায়ে মার্সেইয়ের লিগ শিরোপা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাদের দ্বিতীয় ডিভিশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা ফরাসি ফুটবলের জন্য একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়।

Advertisements

৪. ক্যালচিওপলি কেলেঙ্কারি (২০০৬)
২০০৬ সালের সিরি এ মরসুমে ক্যালচিওপলি কেলেঙ্কারি ফুটবল বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ফিওরেন্টিনা এবং লাজিওর মতো বড় ক্লাবগুলো রেফারিদের প্রভাবিত করে ম্যাচের ফলাফল নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়। জুভেন্টাসের ২০০৪-০৫ এবং ২০০৫-০৬ মরসুমের শিরোপা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাদের দ্বিতীয় ডিভিশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৫-০৬ শিরোপা ইন্টার মিলানকে দেওয়া হয়, যা বিতর্কের জন্ম দেয়।

আই-লিগের বর্তমান পরিস্থিতি

আই-লিগের এই মরসুমে চার্চিল ব্রাদার্স ৪০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থাকলেও, ইন্টার কাশির আপিল সফল হলে তারা ৪২ পয়েন্টে পৌঁছে শিরোপা জিতবে। উভয় দলই সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করেছে। চার্চিল ব্রাদার্সের মালিক আলেমাও দাবি করেছেন, “শিরোপা মাঠে জেতা হয়, আদালতে নয়।” অন্যদিকে, ইন্টার কাশির খেলোয়াড়রা তাদের কোচ আন্তোনিও হাবাসকে কাঁধে তুলে উদযাপন করেছে। এআইএফএফের আপিল কমিটি ১২ এপ্রিল বৈঠকে বসছে, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজেশ ট্যান্ডনের নেতৃত্বে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আই-লিগ ২০২৪-২৫ মরসুমের শিরোপা বিতর্ক ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে। মাঠের খেলার পরিবর্তে আইনি লড়াইয়ে শিরোপা নির্ধারণ ফুটবলের চেতনার পরিপন্থী হলেও, এই নাটকীয়তাই খেলাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চার্চিল ব্রাদার্স তাদের তৃতীয় শিরোপা জিতবে, নাকি ইন্টার কাশি তাদের দ্বিতীয় মরসুমেই ইতিহাস গড়বে—এই প্রশ্নের উত্তর এখন এআইএফএফের হাতে। ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন চূড়ান্ত রায়ের জন্য, যা শুধু শিরোপাই নয়, ইন্ডিয়ান সুপার লিগে (আইএসএল) উন্নীত হওয়ার স্বপ্নও নির্ধারণ করবে।