ভারতীয় ফুটবল (Indian Football) ইতিহাসে অনেক কোচ এসেছেন, গেছেন। কেউ জিতেছেন শিরোপা, কেউ হয়েছেন সমালোচনার মুখে। তবে খালিদ জামিলের (Khalid Jamil) পথ একটু ভিন্ন। তিনি শিরোপার মোহে গা ভাসাননি, বরং ফুটবলকে ভালোবেসে গড়ে তুলেছেন এমন এক যাত্রা, যেখানে সাফল্য শুধুই ট্রফির সংখ্যায় মাপা যায় না।
খালিদ জামিলের শৈশব কেটেছে কুয়েতে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সেখানেই জন্মায়, যদিও তখন তিনি নিজেই ভাবেননি যে এই খেলাটাই একদিন তাঁর জীবনের প্রধান দিকনির্দেশক হয়ে উঠবে। গাল্ফ যুদ্ধের সময় তিনি ভারতে চলে আসেন এবং মুম্বইয়ের রিজভি কলেজে পড়াকালীন ফুটবলের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হন। সেখান থেকেই শুরু পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তাঁর পথচলা—মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড ও এয়ার ইন্ডিয়ার মতো ক্লাবের হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন তিনি।
সুপার কাপের ভবিষৎ নিয়ে বড় বার্তা মার্কুয়েজের!
তবে খালিদের সব সিদ্ধান্তে ছিল একটি স্পষ্ট নীতিগত অবস্থান। বড় মাপের কলকাতা ক্লাবের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কারণ তাদের স্পনসর ছিল অ্যালকোহল কোম্পানি। তিনি জাতীয় সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমার বিবেক আমাকে সেখানে খেলতে দেয়নি।”
২০০৪ সালে চোটে তাঁর খেলার জীবন থেমে যায়। ACL ছিঁড়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা ঠিকমতো না করানোয় তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, শুরু হয় তাঁর কোচিং যাত্রা। ২০০৯ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মুম্বই এফসির প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। সীমিত বাজেট, স্বল্প সুযোগ-সুবিধা—সব কিছু সামলেই দলকে বারবার অবনমন থেকে বাঁচান এবং ২০১৬ সালে ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স এনে দেন।
তবে তাঁর আসল ‘মিরাক্কেল’ আসে ২০১৬-১৭ সিজনে , আইজল এফসির কোচ হিসেবে। যেখানে কেউ তাঁদের হিসেবেও ধরেনি, সেখান থেকে আই-লিগ জয়—ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা ‘আন্ডারডগ’ গল্প। ছোট শহরের এক ছোট ক্লাব, সীমিত রিসোর্স নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে দিলেন খালিদ জামিল।
Khalid Jamil’s coaching career was resurrected thanks to Aizawl FC’s fairytale I-League campaign in 2016/17. Under his tutelage the club from Mizoram, which was reinstated after relegation in 2015/16, went on to win the title on last day of that season #IndianFootball pic.twitter.com/hmWDmfd7VW
— IndianFootball_History (@IndianfootballH) February 5, 2024
এরপর ইস্ বেঙ্গল, নর্থইস্ট ইউনাইটেডের মতো ক্লাবেও দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০২0-21 মরসুমে নর্থইস্টকে প্লে-অফে নিয়ে গিয়ে প্রথম ভারতীয় কোচ হিসেবে আইএসএলে এমন সাফল্য পান তিনি। তবে সব জায়গাতেই তাঁর যাত্রা সহজ ছিল না। সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতা, সমালোচনা, ক্লাব ছাড়াও ছিল।
বর্তমানে তিনি জামশেদপুর এফসির কোচ। স্কট কুপারের পর তিনি দায়িত্ব নেন এবং দলকে ধীরে ধীরে সংগঠিত করেন। চলতি সিজনে জামশেদপুর ইন্ডিয়ান সুপার লিগে পঞ্চম স্থান অধিকার করে, যা তাদের ইতিহাসে অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। যদিও মোহনবাগানের কাছে সেমিফাইনালে শেষ মিনিটে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয় এবং সুপার কাপের ফাইনালেও পরাজয় আসে, তবুও খালিদের দল লড়াই করেছে মাথা উঁচু করে।
খালিদ জামিলের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার ক্ষমতা। তিনি খেলোয়াড়দের ‘রোবট’ বানাতে চান না। বরং তাদের স্বাধীনতা দেন, আত্মবিশ্বাস জোগান। আশুতোষ মেহতা, জয়েশ রানে, আলবিনো গোমসদের মতো খেলোয়াড়রা বারবার তাঁর সঙ্গে ক্লাব বদলেছেন, শুধু বিশ্বাসের কারণে। তিনি বলেন, “খেলোয়াড়দের সময়মতো সঠিক তথ্য দেওয়াটাই আমার কাজ। বাকি কঠোর পরিশ্রমটা ওদের।”
এমন এক মানুষ, যিনি নিজে কখনো লাইমলাইটে থাকতে চাননি, কিন্তু যাঁর ছোঁয়ায় প্রতিটি দলই নতুন করে বিশ্বাস করতে শিখেছে—এই যুগে এমন কোচ দুর্লভ। খালিদ জামিল দেখিয়ে দিয়েছেন, আপনি যদি আন্তরিকতা, পরিশ্রম আর নৈতিকতা নিয়ে এগিয়ে যান, তবে বড় ট্রফি না জিতেও আপনি হয়ে উঠতে পারেন এক অনুপ্রেরণার নাম।