নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ২০২৫ সালের ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের (FIFA Club World Cup) ফাইনালে চেলসি ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন প্যারিস সেন্ট-জার্মেই (পিএসজি)-কে ৩-০ গোলে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এই জয়ের মাধ্যমে চেলসি ইংল্যান্ডের প্রথম ক্লাব হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় একাধিক শিরোপা জিতেছে। কোল পামারের দুটি গোল এবং নতুন সই করা ব্রাজিলিয়ান তারকা জোয়াও পেদ্রোর একটি দুর্দান্ত গোলের সৌজন্যে চেলসি এই ম্যাচে আধিপত্য বিস্তার করে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ঐতিহাসিক জয়, ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, এবং পশ্চিমবঙ্গের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করব।
ম্যাচের হাইলাইটস
১৩ জুলাই, ২০২৫-এ মেটলাইফ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচে চেলসি প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে। ম্যাচের প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যেই তারা গতি নির্ধারণ করে এবং পিএসজির উপর চাপ সৃষ্টি করে। কোল পামার ২২ এবং ৩০ মিনিটে দুটি গোল করে চেলসিকে ২-০ তে এগিয়ে দেন। তার প্রথম গোলটি ছিল একটি দুর্দান্ত ফিনিশ, যেখানে তিনি পিএসজির ডিফেন্সের ফাঁক দিয়ে বল জালে পাঠান। দ্বিতীয় গোলটি ছিল তার কৌশলগত দক্ষতার প্রমাণ, যেখানে তিনি একটি দ্রুত কাউন্টার-অ্যাটাক থেকে গোল করেন। এরপর, প্রথমার্ধের ৪৩ মিনিটে জোয়াও পেদ্রো একটি দুর্দান্ত গোল করে চেলসির লিড ৩-০ করেন। এই গোলটি পিএসজির ডিফেন্সকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয় এবং ম্যাচের ফলাফল প্রায় নিশ্চিত করে।
চেলসির গোলরক্ষক রবার্ট সানচেজ এই ম্যাচে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখান, পিএসজির একাধিক আক্রমণ প্রতিহত করে। তিনি টুর্নামেন্টে সবচেয়ে কম গোল হজম করার জন্য গোল্ডেন গ্লাভ পুরস্কার জিতেছেন। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে পিএসজি চেষ্টা করলেও চেলসির শক্তিশালী ডিফেন্স এবং কৌশলগত খেলার কাছে তারা কোনো সুযোগ পায়নি। ম্যাচের শেষের দিকে পিএসজির জোয়াও নেভেস ৮৫ মিনিটে লাল কার্ড পান, যা তাদের পরাজয়কে আরও নিশ্চিত করে।
চেলসির বিজয়ের পেছনের কৌশল
চেলসির কোচ এনজো মারেস্কা এই ম্যাচে তার কৌশলগত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রথম ১০ মিনিটে ম্যাচের গতি নিয়ন্ত্রণ করেছি। আমাদের প্রেসিং এবং দ্রুত আক্রমণ পিএসজিকে চাপে রেখেছিল।” মারেস্কার নেতৃত্বে চেলসি একটি নিয়ন্ত্রিত, পদ্ধতিগত পজেশন খেলেছে, যেখানে তারা মাত্র ৪.৫% লং পাস ব্যবহার করেছে। তবে, যখন সুযোগ এসেছে, তখন পেদ্রো নেটো এবং জোয়াও পেদ্রোর মতো খেলোয়াড়রা দ্রুত আক্রমণের মাধ্যমে গোল করেছে।
জোয়াও পেদ্রো, যিনি সম্প্রতি চেলসিতে যোগ দিয়েছেন, এই টুর্নামেন্টে একটি অপ্রত্যাশিত তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। সেমিফাইনালে ফ্লুমিনেন্সের বিরুদ্ধে দুটি গোল এবং ফাইনালে একটি গোল তাকে চেলসির সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। তার ব্রাজিলিয়ান পতাকা কোমরে জড়িয়ে মেডেল গ্রহণের দৃশ্য ছিল আবেগপ্রবণ। কোল পামার, যিনি গোল্ডেন বল জিতেছেন, তিনি এই ম্যাচে দুটি গোল এবং একটি অ্যাসিস্ট করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পিএসজির হতাশা এবং বিতর্ক
পিএসজি, যারা ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হিসেবে এই টুর্নামেন্টে প্রবেশ করেছিল, ফাইনালে তাদের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলে। তাদের কোচ লুইস এনরিকে ম্যাচের পর জোয়াও পেদ্রোর দিকে হাত তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করেন, যার জন্য তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এছাড়াও, জোয়াও নেভেসের লাল কার্ড এবং দলের খেলোয়াড়দের হতাশাজনক আচরণ পিএসজির জন্য এই পরাজয়কে আরও তিক্ত করে তুলেছে। তবে, পিএসজির মিডফিল্ডার ভিতিনিয়া এবং ফরোয়ার্ড ওসমান ডেম্বেলে টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, যদিও ফাইনালে তারা চেলসির ডিফেন্সের কাছে ম্লান হয়ে যান।
চেলসির বিজয়ের তাৎপর্য
চেলসির এই জয় তাদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ২০২১ সালে প্রথমবার ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পর, এই জয় তাদের বিশ্ব ফুটবলে শীর্ষস্থানীয় ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চেলসি এখন রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ এবং করিন্থিয়ান্সের পাশাপাশি একাধিক ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ জয়ী ক্লাবগুলির তালিকায় যোগ দিয়েছে। এই জয় চেলসির মালিক টড বোহলি এবং ক্লিয়ারলেক ক্যাপিটালের বিনিয়োগের সাফল্যের প্রমাণ। টুর্নামেন্ট থেকে তারা প্রায় ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করেছে, যা ক্লাবের আর্থিক শক্তি বাড়াবে।
পশ্চিমবঙ্গের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এই জয় বিশেষ গর্বের। কলকাতা এবং দুর্গাপুরের মতো শহরে চেলসির সমর্থকরা এই জয় উদযাপন করছেন। অনেকে এই জয়কে তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি প্রেরণা হিসেবে দেখছেন, বিশেষ করে জোয়াও পেদ্রোর মতো তরুণ খেলোয়াড়দের উত্থানের কারণে।
ম্যাচের পরিসংখ্যান এবং পুরস্কার
ম্যাচে চেলসির আধিপত্য ছিল স্পষ্ট। তারা দ্রুত পাসিং এবং কাউন্টার-অ্যাটাকের মাধ্যমে পিএসজির শক্তিশালী আক্রমণকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। কোল পামার এই টুর্নামেন্টে ১৮টি গোল এবং ১৪টি অ্যাসিস্টের জন্য গোল্ডেন বল জিতেছেন। রবার্ট সানচেজ গোল্ডেন গ্লাভ জিতেছেন, এবং পিএসজির ডিজায়ার ডুয়ে সেরা তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই জয়ের পর চেলসি তাদের খেলোয়াড়দের তিন সপ্তাহের ছুটি দেবে, এরপর তারা ২০২৫-২৬ মৌসুমের জন্য প্রস্তুতি শুরু করবে। মারেস্কা বলেন, “আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎসাহিত, তবে এখন আমি ছুটির জন্য আরও উৎসাহিত।” পিএসজি, যারা এই মৌসুমে লিগ ওয়ান, কুপ দে ফ্রান্স এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে, তাদের এই পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউয়েফা সুপার কাপের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
চেলসির এই ৩-০ জয় ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৫-এর একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কোল পামার এবং জোয়াও পেদ্রোর মতো খেলোয়াড়দের নেতৃত্বে এবং এনজো মারেস্কার কৌশলগত দক্ষতায় চেলসি বিশ্ব ফুটবলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের ফুটবলপ্রেমীরা এই জয়কে একটি উৎসব হিসেবে উদযাপন করছে, এবং এটি তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য একটি বড় প্রেরণা। এই জয় শুধু চেলসির জন্য নয়, বরং বিশ্ব ফুটবলের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।