বেঙ্গালুরু, ৫ জুন ২০২৫: বেঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (আরসিবি)-এর আইপিএল ২০২৫ জয় উদযাপনের সময় সংঘটিত মর্মান্তিক ভিড়ের (Bengaluru Stampede) ঘটনায় ১১ জনের প্রাণহানি ও ৩৩ জন আহত হওয়ার একদিন পর, কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থমাইয়া বৃহস্পতিবার বেঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার বি দয়ানন্দসহ একাধিক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া, এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আরসিবি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ডিএনএ এন্টারটেনমেন্ট এবং কর্ণাটক স্টেট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (কেএসসিএ)-এর প্রতিনিধিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থমাইয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “কাব্বন পার্ক থানার পুলিশ ইনস্পেক্টর, স্টেশন হাউস মাস্টার, স্টেশন হাউস অফিসার, সেন্ট্রাল ডিভিশনের এসিপি, ডিসিপি, ক্রিকেট স্টেডিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এবং বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশ কমিশনারকে তাৎক্ষণিকভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে।”
Bengaluru stampede | Karnataka CM Siddaramaiah says, “Cubbon Park Police Station Police Inspector, Station House Master, Station House Officer, ACP, Central Division DCP, Cricket Stadium in-charge, Additional Commissioner of Police, Commisioner of Police have been suspended with… pic.twitter.com/3U9YS8CLhm
— ANI (@ANI) June 5, 2025
এক সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন
এই ঘটনার তদন্তে করি করতে কর্ণাটক সরকার প্রাক্তন হাইকোর্ট বিচারপতি মাইকেল ডি’কুনহার নেতৃত্বে এক সদস্যের কমিশন গঠন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই কমিশন ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্তে ভিড় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, পরিকল্পনার ত্রুটি এবং অন্যান্য দায়দায়িত্বের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়া, ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে দেওয়া হয়েছে, যারা একটি বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করবে।
বেঙ্গালুরু পুলিশের বিরুদ্ধে এফআইআর
বৃহস্পতিবার সকালে, বেঙ্গালুরু পুলিশ কাব্বন পার্ক থানায় আরসিবি, কেএসসিএ এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ডিএনএ এন্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করেছে। একজন পুলিশ ইনস্পেক্টরের অভিযোগের ভিত্তিতে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। এফআইআর-এ ভারতীয় ন্যায় সংহিতার বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা (ধারা ১১৫), বিপজ্জনক অস্ত্র বা উপায়ে আঘাত বা গুরুতর আঘাত করা (ধারা ১১৮), সরকারি কর্মচারীকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার জন্য আঘাত করা (ধারা ১২১) এবং অবৈধ সমাবেশ (ধারা ১৯০)।
মেগা ইভেন্টের জন্য নতুন এসওপি
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, কর্ণাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বর ঘোষণা করেছেন যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে মেগা ইভেন্ট, সভা এবং উদযাপনের জন্য নতুন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, “এই ধরনের বড় ইভেন্টে ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তার জন্য আরও কঠোর নির্দেশিকা প্রয়োজন। আমরা এই বিষয়ে দ্রুত কাজ শুরু করব।”
শোকাহত পরিবারের ক্ষোভ
সরকারের ঘোষণা এবং এফআইআর দায়ের সত্ত্বেও, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর শোক এবং ক্ষোভ কমেনি। ১৫ বছর বয়সী দিব্যাংশীর বাবা শিবকুমার বলেন, “কেন তারা সঠিক ব্যবস্থা করেনি? মহীশূর প্যালেস রোডে রাজনৈতিক ইভেন্টের জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করা হয়। এই উদযাপনের জন্য কেন সঠিক পরিকল্পনা ছিল না? গোয়েন্দা তথ্য থাকা উচিত ছিল।” তিনি সরকার ও ইভেন্ট আয়োজকদের উদাসীনতার জন্য দায়ী করেছেন।
ঘটনার পটভূমি
গত মঙ্গলবার (৩ জুন) আহমেদাবাদে পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে ছয় রানে জয়ী হয়ে আরসিবি তাদের ১৮ বছরের আইপিএল ইতিহাসে প্রথম শিরোপা জিতেছিল। বুধবার (৪ জুন) বেঙ্গালুরুতে দলের ফিরে আসার পর কেএসসিএ একটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু, স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ৩৫,০০০ হলেও, প্রায় ২.৫ থেকে ৩ লক্ষ মানুষ এই উদযাপনে অংশ নিতে জড়ো হয়। ফ্রি পাস এবং বিজয়ী মিছিল নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, একটি অস্থায়ী ব্যারিকেড ভেঙে পড়ায় এবং ভিড়ের ধাক্কায় এই দুর্ঘটনা ঘটে।
রাজনৈতিক বিতর্ক
এই ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও তীব্র হয়েছে। বিজেপি নেতা বি ওয়াই বিজয়েন্দ্র সরকারের প্রস্তুতির অভাব এবং রাজনৈতিক প্রচারের জন্য এই ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “সরকারের তাড়াহুড়ো করে বিজয়ী মিছিলের আয়োজন এই দুর্ঘটনার কারণ। কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না।” অন্যদিকে, উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার ভিড়ের অপ্রত্যাশিত আগমনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, “আমরা এই দায়িত্ব এড়াচ্ছি না। এটি অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে।”
ক্ষতিপূরণ ও সহায়তা
কর্ণাটক সরকার মৃতদের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। এছাড়া, আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরসিবিও মৃতদের পরিবারের জন্য ১০ লক্ষ টাকা এবং কেএসসিএ ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। তবে, এই ক্ষতিপূরণ শোকাহত পরিবারগুলোর ক্ষতি পূরণ করতে পারেনি।
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের এই মর্মান্তিক ঘটনা ভারতের ক্রীড়া উদযাপন এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটি তুলে ধরেছে। সরকার, পুলিশ এবং ইভেন্ট আয়োজকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তদন্ত প্রতিবেদন এবং নতুন এসওপি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলবে।