ভারতীয় মহিলা ফুটবলের অন্যতম প্রধান নক্ষত্র অদিতি চৌহান (Aditi Chauhan) সম্প্রতি তাঁর পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানার ঘোষণা করেছেন। ১৭ বছরের এক ঝলমলে ক্যারিয়ারের পর তিনি অবসর নিয়েছেন, যা শুধুমাত্র ফুটবলের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি ভারতীয় মহিলা ফুটবলের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ইংল্যান্ডের ফুটবল লিগে প্রথম ভারতীয় মহিলা খেলোয়াড় হিসেবে খেলা থেকে শুরু করে দেশের হয়ে একাধিক ট্রফি জয়, অদিতির জীবন গল্প একটি প্রেরণার উৎস। তাঁর এই অবসর শুধু একজন খেলোয়াড়ের বিদায় নয়, বরং ভারতীয় মহিলা ফুটবলের একটি যুগের সমাপ্তি।
অদিতি চৌহানের ক্যারিয়ারের শুরু
অদিতি চৌহানের জন্ম চেন্নাইয়ে, এবং নয় বছর বয়সে তাঁর পরিবার দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। শৈশবে তিনি কারাতে এবং বাস্কেটবলের মতো খেলায় অংশ নিয়েছিলেন এবং এমনকি দিল্লির যুব রাজ্য বাস্কেটবল দলের জন্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কোচের পরামর্শে ফুটবলের গোলকিপার হিসেবে ট্রায়াল দেওয়ার সিদ্ধান্ত তাঁর জীবন বদলে দেয়। ১৭ বছর বয়সে তিনি ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ জাতীয় দলে অভিষেক করেন এবং ২০১১ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (AFC) অলিম্পিক কোয়ালিফায়ারে সিনিয়র জাতীয় দলের হয়ে প্রথম খেলেন।
২০১৫ সালে অদিতি ইতিহাস গড়েন যখন তিনি ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড লেডিস দলের হয়ে খেলেন, এবং এইভাবে ইংলিশ লিগে খেলা প্রথম ভারতীয় মহিলা ফুটবলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই কৃতিত্ব তাঁকে শুধু ভারতের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও স্বীকৃতি এনে দেয়। তিনি লাফবরো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দলের প্রতিনিধিত্বও করেন।
অদিতির কৃতিত্বের তালিকা
অদিতি চৌহানের ক্যারিয়ারে অর্জনের কোনও কমতি নেই। তিনি ভারতীয় মহিলা জাতীয় দলের হয়ে ৫৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন এবং তিনটি SAFF চ্যাম্পিয়নশিপ (২০১২, ২০১৬, ২০১৯) এবং দুটি দক্ষিণ এশীয় গেমসের স্বর্ণপদক (২০১৬, ২০১৯) জিতেছেন। দেশের ক্লাব পর্যায়ে, তিনি গোকুলাম কেরালা এফসি-র হয়ে তিনটি ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগ (IWL) শিরোপা জিতেছেন—২০১৯-২০, ২০২১-২২, এবং ২০২২-২৩। এছাড়া, তিনি AFC উইমেন্স ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে গোকুলাম কেরালার প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যেখানে দলটি তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
২০১৫ সালে তিনি এশিয়ান উইমেন ফুটবলার অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার জিতে ভারতের জন্য আরেকটি গৌরব বয়ে আনেন। এছাড়া, ইন্ডিয়া ইউকে অ্যাচিভার্স অনার্স তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, যা তাঁর ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি। তবে, তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল দুটি গুরুতর ACL (অ্যান্টিরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট) ইনজুরি থেকে ফিরে এসে নিজেকে প্রমাণ করা। তাঁর শেষ মৌসুমে, তিনি নবাগত শ্রীভূমি এফসি-কে IWL-এ তৃতীয় স্থানে নিয়ে যান, যা তাঁর ধারাবাহিকতা এবং নেতৃত্বের প্রমাণ।
মাঠের বাইরে অদিতির অবদান
অদিতি চৌহান শুধু একজন খেলোয়াড়ই নন, তিনি একজন সমাজসেবী এবং প্রেরণাদাত্রী। ২০১৮ সালে তিনি দিল্লিতে ‘শি কিকস ফুটবল অ্যাকাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের ফুটবলে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তাদের পেশাদার ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করা। এই অ্যাকাডেমি মেয়েদের জন্য একটি নিরাপদ এবং পেশাদার পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে তারা পুষ্টি, শক্তি প্রশিক্ষণ, এবং মানসিক প্রস্তুতির উপর জোর দেওয়া হয়। তিনি সম্প্রতি ইউকে এলিট স্পোর্টস গ্রুপের সঙ্গে অংশীদারিত্ব করেছেন, যা ভারতে গ্রাসরুট ফুটবল উন্নয়নে সহায়তা করবে।
এছাড়া, অদিতি টেলিভিশনে ফুটবল বিশ্লেষক এবং ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন। ২০২২ সালে তিনি দুরান্ত কাপের ধারাভাষ্য দিয়েছেন, যা মহিলা ফুটবলের প্রতি দর্শকদের আগ্রহ বাড়িয়েছে। তাঁর এই কাজ ভারতীয় মহিলা ফুটবলের প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অদিতির অবসর ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অদিতি তাঁর অবসর ঘোষণায় বলেছেন, “ফুটবল আমাকে শুধু একটি ক্যারিয়ারই দেয়নি, এটি আমাকে একটি পরিচয় দিয়েছে। আমি এখনও পুরোপুরি শেষ করিনি। আমার দ্বিতীয় অর্ধেক এখন ফুটবলকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শক্তিশালী পথ তৈরি করার জন্য।” তিনি ফুটবলের উন্নয়নে কাজ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিশেষ করে মহিলা ফুটবলের প্রচারে। তাঁর অ্যাকাডেমির মাধ্যমে তিনি আরও মেয়েদের ফুটবলে আনতে চান এবং ভারতীয় ফুটবলের ইকোসিস্টেমকে আরও উন্নত করতে চান।
অদিতি চৌহানের অবসর ভারতীয় মহিলা ফুটবলের জন্য একটি বড় ক্ষতি হলেও, তাঁর উত্তরাধিকার চিরস্থায়ী। তিনি শুধু মাঠে তাঁর দক্ষতা দিয়ে নয়, মাঠের বাইরে তাঁর উদ্যোগের মাধ্যমেও ভারতীয় ফুটবলের মুখ বদলে দিয়েছেন। তাঁর গল্প প্রমাণ করে যে সংকল্প, কঠোর পরিশ্রম, এবং স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলার মাধ্যমে যেকোনও বাধা অতিক্রম করা সম্ভব। অদিতি চৌহানের এই যাত্রা ভারতের মেয়েদের জন্য একটি আলোর পথ, যারা ফুটবলের মাধ্যমে নিজেদের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।