শ্যামাপোকা কী বিলুপ্তের পথে! কী বলছেন বিজ্ঞানীরা

পুজোর সময় যখন চারপাশে শ্যামাপোকার (Shyama Poka ) উৎপাত চোখে পড়ে, তখন অনেকের কাছে এটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। কখনও খাবারে পড়ে, কখনও চোখে ঢোকে—এই পোকার অত্যাচার…

Shyama Poka Declared Extinct

পুজোর সময় যখন চারপাশে শ্যামাপোকার (Shyama Poka ) উৎপাত চোখে পড়ে, তখন অনেকের কাছে এটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। কখনও খাবারে পড়ে, কখনও চোখে ঢোকে—এই পোকার অত্যাচার বেশ পরিচিত। তবে এ বছর সেই পরিচিত শ্যামাপোকা যেন উধাও। ফলে অনেকেই উদ্বেগে পড়েছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন, শ্যামাপোকা কি বিলুপ্তির পথে? এ ধরনের ঘটনা কি বাস্তুতন্ত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?

বিজ্ঞানীদের মতে, বাস্তব সত্য হলো শ্যামাপোকা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, তবে এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। বিশেষত এ বছর শ্যামাপোকার একদমই দেখা মিলছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্যামাপোকার এই কমে যাওয়ার কারণ প্রকৃতির পরিবর্তন এবং বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ‘দানার’ প্রভাব। ধান চাষের মরসুমে শ্যামাপোকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং অক্টোবরে এর উৎপাত শুরু হয়। ধানগাছের গোড়ায় এই পোকা জন্মায়, এবং ধানগাছের রসই এদের প্রধান খাবার।

   

কীভাবে ধান চাষে শ্যামাপোকার প্রভাব?
ধান চাষের ক্ষেত্রেই শ্যামাপোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। ধানগাছে শ্যামাপোকা আক্রমণ করলে গাছের রস শুষে নিয়ে গাছকে দুর্বল করে তোলে। ফলে ধানের ফলন কমে যায় এবং কৃষকদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই চাষিরা প্রায়শই কীটনাশক ব্যবহার করে শ্যামাপোকা নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারই শ্যামাপোকার সংখ্যায় বড় ভূমিকা রেখেছে। কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারে শুধু শ্যামাপোকাই নয়, অনেক অন্যান্য প্রজাতির পোকামাকড়ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাব
এ বছর ঘূর্ণিঝড় দানা ও বৃষ্টিপাত শ্যামাপোকার জীবনচক্রে বড় প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে অনেক জায়গায় ধানগাছ নষ্ট হয়েছে। শ্যামাপোকা সাধারণত ধানগাছের গোড়ায় জন্মায়, এবং ধানগাছ নষ্ট হলে স্বাভাবিকভাবেই শ্যামাপোকার সংখ্যা কমে যায়। পুজোর আগেই নিম্নচাপের বৃষ্টি এবং পুজোর পরে ঘূর্ণিঝড় দানা ধানচাষে মারাত্মক ক্ষতি করেছে, যার প্রভাব পড়েছে শ্যামাপোকার ওপরেও।

শ্যামাপোকার সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ
প্রথমত, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে শ্যামাপোকাসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টির কারণে ধানক্ষেত নষ্ট হওয়ায় শ্যামাপোকার জন্ম ও প্রজনন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এছাড়া, আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রভাবও শ্যামাপোকার জীবনে প্রভাব ফেলেছে।

শ্যামাপোকা হারিয়ে গেলে বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব
প্রশ্ন আসছে, শ্যামাপোকা যদি একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে কি বাস্তুতন্ত্রের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের অভিমত হলো, শ্যামাপোকা বিলুপ্ত হলেও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য তেমনভাবে নষ্ট হবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্যামাপোকা কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর এবং এদের সংখ্যা কমলে কৃষকদের লাভই হবে। কারণ, শ্যামাপোকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে চাষিদের প্রচুর কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, যা চাষিদের জন্য অতিরিক্ত খরচের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শ্যামাপোকা কমে গেলে এই কীটনাশকের প্রয়োজনও কমে আসবে।

এছাড়া, পরিবেশে এমন অনেক বন্ধু পোকা রয়েছে যারা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, লেডিবাগ পোকা, প্রার্থী মাকড়সা ও অন্যান্য প্রজাতির পোকা শ্যামাপোকার চেয়ে বাস্তুতন্ত্রে ভালো প্রভাব ফেলে এবং এরা ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, শ্যামাপোকা কমে গেলে এই বন্ধু পোকাগুলি আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

সমাধান এবং ভবিষ্যৎ
কৃষিক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং শ্যামাপোকার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার এবং পরিবেশ-বান্ধব চাষাবাদ পদ্ধতির প্রচলন। প্রাকৃতিক শত্রু পোকাদের সংরক্ষণ এবং ব্যবহার বাড়িয়ে শ্যামাপোকাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এছাড়া, গবেষকদের মতে জৈবিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করে কীটনাশকের প্রভাব কমানো যেতে পারে।

সুতরাং, শ্যামাপোকার সংখ্যা কমলেও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যে বড় কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং চাষিদের জন্য এটি একটি ভালো দিক হতে পারে, কারণ এর ফলে তাদের খরচ কমে যাবে এবং পরিবেশ-বান্ধব চাষাবাদ ব্যবস্থা উন্নত হবে।