নয়াদিল্লি: বিশ্বজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা একত্রে সভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে, তখন ভারত ও আমেরিকার যৌথ মহাকাশ অভিযান ‘নিসার’ হয়ে উঠতে চলেছে আধুনিক পৃথিবীর মানচিত্র রচনার নতুন যন্ত্র। এই প্রথম, একটি উপগ্রহ মিলিমিটার-পর্যায়ের ভূ-পৃষ্ঠ পরিবর্তন, গ্লেশিয়ারের গতি কিংবা ভূমিকম্পের আগাম সংকেত পাঠাতে পারবে মহাকাশ থেকে তা-ও সম্পূর্ণ ওপেন-সোর্স, বিজ্ঞানসম্মত ও সর্বজনপ্রাপ্ত তথ্যভাণ্ডার হিসেবে। নিসার শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তি নয়, এটি মানব সভ্যতার পরবর্তী ধাপে পা রাখার এক নিঃশব্দ বিপ্লব, আর সেই বিপ্লবের অন্যতম কারিগর ভারত নিজেই (India US NISAR space mission)।
ভারতের নিজস্ব উৎক্ষেপণ ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা
নিসার মিশনের অন্যতম গর্বের বিষয় হল, এটি উৎক্ষেপিত হবে ভারতের নিজস্ব জিওসিঙ্ক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক-২ (GSLV-MkII) রকেটের মাধ্যমে। উৎক্ষেপণস্থলও সম্পূর্ণ দেশীয়, শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশ কেন্দ্র। এই যৌথ মিশনে ইসরোর নিজস্ব প্রযুক্তিগত অংশগ্রহণ, বিশেষত S-ব্যান্ড রাডারের নির্মাণ ও উৎক্ষেপণের দায়িত্ব নেওয়া, ভারতকে শুধু এক সফল সহযোগী নয়, বরং এক প্রযুক্তিনির্ভর নেতৃত্বের অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এটা ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে আমরা কেবল গ্রহণকারী নই, বরং বিশ্বমানের প্রদানকারী।
খরচে সংযম, সুফলে বিপুলতা: ভারতের কৌশলগত বিনিয়োগ
পুরো নিসার প্রকল্পের খরচ আনুমানিক ১২,৫০০ কোটি টাকা বা ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ভারতের আর্থিক অংশীদারি মাত্র ৭৮৮ কোটি টাকা, শতাংশের হিসেবে তুলনামূলকভাবে সামান্য হলেও ফলাফলের বিচারে বিশাল কৌশলগত সাফল্য। এই সীমিত বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত পাবে প্রতিদিনের ভিত্তিতে বিশ্বমানের, ওপেন-সোর্স ভূ-তথ্য যা পরিবেশ, কৃষি, দুর্যোগ, নগর পরিকল্পনা, জলবায়ু পরিবর্তন সহ বহু ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। শুধু তাই নয়, ভারতের তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই ডেটায় সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাবেন, যা ভবিষ্যতের মহাকাশ প্রযুক্তি উন্নয়নে এক অসামান্য ভিত্তি গড়ে তুলবে।
প্রযুক্তির পরাকাষ্ঠা: দ্বৈত ফ্রিকোয়েন্সি রাডার ও নিখুঁত নজরদারি
নিসার-এর সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এর দ্বৈত ফ্রিকোয়েন্সি স্যিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডার, নাসার এল-ব্যান্ড ও ইসরোর এস-ব্যান্ড-এর সংমিশ্রণ, যা বিশ্বের কোনও ভূ-পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহের মধ্যে প্রথম। এর মাধ্যমে নিসার মেঘ, কুয়াশা, বনাঞ্চল এমনকি অন্ধকার রাতের মধ্যেও ভূপৃষ্ঠের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। এমনকি ভূগর্ভস্থ স্থির পরিবর্তনও যেমন ভূমি সরে যাওয়া, জলস্তরের পতন কিংবা গ্লেশিয়ারের ক্ষয়-পর্যবেক্ষণ করা যাবে মিলিমিটারের মতো সূক্ষ্মতায়। পৃথিবীকে এটি প্রতি ৯৭ মিনিটে একবার প্রদক্ষিণ করবে এবং মাত্র ১২ দিনের মধ্যেই প্রায় গোটা ভূমি ও বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল ম্যাপ করে ফেলবে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় নিসার: আগে থেকেই জানা যাবে বিপদের ইঙ্গিত
নিসার প্রকৃত অর্থেই এক বিপর্যয়-প্রতিরোধী প্রযুক্তি। এটি ভূমিকম্পের ফল্টলাইন নজরে রাখবে, ভূমিধস-পূর্ববর্তী ভূমির গঠনগত পরিবর্তন সনাক্ত করবে, মাটির নিচে জলস্তর কমে যাওয়ার ফলে ভূমি ধসে পড়ার আশঙ্কা আগেভাগেই ধরতে পারবে। ফলে অসম বা হিমালয়াঞ্চলের মতো দুর্যোগপ্রবণ রাজ্যগুলিতে আগাম সতর্কবার্তা জারি করা সম্ভব হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর উদ্ধারকাজেও নিসার ডেটা হয়ে উঠবে অমূল্য। এটি এককথায় আমাদের প্রতিদিনকার নিরাপত্তাকে প্রযুক্তিগত স্তরে বহু গুণ বাড়িয়ে তুলবে।
কৃষি, জল ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় নিসার-এর নতুন অধ্যায়
ভারতের মতো কৃষিনির্ভর দেশে নিসার হতে চলেছে এক নিঃশব্দ বিপ্লব। এর ডেটা ব্যবহার করে কৃষি জমির আর্দ্রতা, ফসলের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন, জলাধারের গঠন ও পরিমাণ সবই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদি জল ব্যবস্থাপনা, খরার পূর্বাভাস, এমনকি মৌসুমী পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে ফসল বপনের কৌশল নির্ধারণেও নিসার হয়ে উঠবে অপরিহার্য হাতিয়ার। পাশাপাশি হিমবাহের গতি ও গলনের হার নিরীক্ষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয় সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ ও মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
বৈশ্বিক বিজ্ঞানমঞ্চে ভারতের অবস্থান আরও সুদৃঢ়
নাসার সঙ্গে এই যৌথ মিশন কেবল একটি প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, এটি এক বিশাল কূটনৈতিক অর্জনও। নিসারের মাধ্যমে ভারত যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের উপস্থিতি দৃঢ় করছে, তেমনই এটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহাশক্তিধর দেশের সঙ্গে ভারতের অংশীদারি শক্তিকে এক নতুন মাত্রা দিচ্ছে। এটি ভবিষ্যতের মহাকাশ সহযোগিতা ও বৈশ্বিক জলবায়ু লড়াইয়ে ভারতের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করবে।