স্বর্ণার্ক ঘোষ: বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের অভ্যর্থনা জানাতে অথবা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাধারনত কামান দাগা হয়। একুশ তোপের ধ্বনিতে বিজয়োৎসব পালন করে বহু দেশ। এমনটাই সকলে জানে। কিন্তু জানেন কি দুর্গাপুজোতেও (Durga puja) তোপ দাগা হয় এই বাংলার বুকে। অষ্টমী পুজো ও নবমীর সন্ধিক্ষণে তিনটে কামান দেগে সূচনা হয় সন্ধিপুজোর। হ্যাঁ বিগত কয়েক শত বছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। শহর থেকে অদূরে টিলার ওপর তিনটে কামান দেগেই সূচনা হয় সন্ধিপুজোর।
দেবী যশোরেশ্বরীর মুকুট চোরের ছবি প্রকাশ, বাংলাদেশ জুড়ে খোঁজ চলছে
আর সেই তোপের আওয়াজে আনন্দে-কলরবে মেতে ওঠে গোটা শহর। সেই দৃশ্য দেখতে সুদূর কলকাতা থেকেও ভিড় জমান বহু দর্শনার্থী। কালের বিবর্তনেও কয়েক’শ বছরের ঐতিহ্য আজও অঁটুট রেখেছে বাঁকু়ড়াবাসী।
এই কামান দাগার প্রথাটি শুরু করেন বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা। অষ্টমীর পুজো বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ। পুষ্পাঞ্জলির পরে হয় তোপধ্বনি। নবমীর মধ্য রাতে মহামারীর দেবী খচ্চরবাহিনী-র বিশেষ পুজো হয়। পুরোহিত ঘটের দিকে পিছন ফিরে বসে এই পুজো করে থাকেন। সেই সময় ওই মন্দিরে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
দেশজুড়ে চিকিৎসা বন্ধের হুঁশিয়ারি IMA’র, মোদীর দিকে তোপ ঘোরাতে ধীরে চলছেন মমতা?
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। আর কিছুটা অলৌকিকও বটে। সময়টা ছিল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ। ওই অঞ্চলের জনশ্রুতি অনুযায়ী, মল্ল রাজপরিবারের দুর্গাপূজা ১৯ দিন ধরে চলে দুর্গাপুজো। যা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা দুষ্কর। দুর্গা পূজিতা হন “দেবী মৃন্ময়ী” নামে।
প্রচলিত গাঁথা অনুযায়ী, মল্লভূমের ১৯ তম মল্লরাজ জগৎমল্ল একদিন তাঁর রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে শিকার করতে বেরিয়ে বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে আসেন। সেখানে এক হরিণের পিছু নেন তিনি। কিন্তু বাণ নিক্ষেপ করতেই সেটি চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যায়। এবারে রাজার চোখ পড়ল গাছের ডালে বসা এক বকের ওপর। তিনি তাঁর শিকারি বাজপাখিটিকে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, সেই বকের তাড়া খেয়ে বাজপাখি ভীত হয়ে আবার রাজার কাছেই ফিরে আসে। বিস্মিত রাজা যখন এই নিয়ে চিন্তিত, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন এক অপূর্ব লাবণ্যময়ী রমণীকে।
অষ্টমীর সকালে হুড়মুড়িয়ে নামল সোনার দাম, কলকাতায় কত জানেন?
রাজা সেই নারীর পেছনে ধাওয়া মাত্র মুখে এক বিকট আওয়াজ করে অন্তর্ধান করে গেলেন ওই নারীটি। সঙ্গে সঙ্গে আকাশে দৈববাণী আসে- “আমি শিবসহচরী শিবানী, আমায় মূর্তিরূপে স্থাপন করে নিত্য পূজা ও ভোগরাগের সুবন্দোবস্ত করো।” রাজা বুঝলেন, মহামায়ার কৃপা হয়েছে। চিন্ময়ী এবারে মৃন্ময়ী আধারে রাজপরিবারের সদস্যা হতে চান। দেবীর আদেশ অনুযায়ী রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে স্থানান্তরিত করে আনা হল বিষ্ণুপুরে। নির্মিত হল মৃন্ময়ী দেবীর মন্দির, প্রতিষ্ঠিত হল মায়ের হাস্যময়ী বিগ্রহ। এই অঞ্চলেরই নাম বন বিষ্ণুপুর। ওই মৃন্ময়ী দেবীর মন্দিরে নরবলীও হত। কিন্তু মল্লরাজ বীর হাম্বির বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার পর নিষিদ্ধ হয় নরবলি প্রথার।
কালের বিবর্তনে আজ কোনও রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। নেই কোনও নরবলি প্রথাও। তবে বহু যুগের সাক্ষী হয়ে আজ পড়ে রয়েছে শুধুই রাজতন্ত্রের দেওয়াল-কাঠামো। তারমধ্যেই মল্লভূমে বেঁচে রয়েছে কয়েক’ শ বছরের সেই কামান দাগার প্রথা।