পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে টেলিভিশন বিতর্কসভা বা টক শো অনেকদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, এবং অর্থনীতি নিয়ে মুখোমুখি বিতর্কে অংশ নেন নানা রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশ্লেষক, সাংবাদিক এবং মাঝেমধ্যে ধর্মীয় নেতারাও। কিন্তু এবার এই বিতর্ক সভা এবং তাতে সাধু-সন্ত, মৌলবীদের উপস্থিতি নিয়ে সরব হলেন তৃণমূল মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য (Debangshu Bhattacharya)। তাঁর একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরেই তৈরি হয়েছে বিতর্কের নতুন সূত্র।
মঙ্গলবার রাতে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দেবাংশু লেখেন,
“বিজেপি নেতারা সাধু-সন্ত সেজে টিভিতে চলে আসছে! পাশেই বসে থাকছে মৌলবী! এক একজন এক একটা দলের হয়ে ব্যাটিং করে আরও বেশি করে হিন্দুদের মনে বিজেপি সম্পর্কে সফট কর্ণার তৈরি করে দিচ্ছে… বার্তা দেওয়া হচ্ছে, ‘ওই দেখো টুপি-দাড়িওয়ালা লোক তৃণমূলের পক্ষে বলছে! আর মাথায় চন্দন দেওয়া, গেরুয়া বসন ধারণ করা সাধু তৃণমূলের বিরুদ্ধে বলছে, বিজেপির পক্ষে বলছে।’ বাংলার খবরের চ্যানেল গুলোও ন্যাশনাল মিডিয়াকে ফলো করা শুরু করল এভাবে? নিউজ চ্যানেল কেন আস্থা টিভি হয়ে উঠবে বলতে পারেন?”
এই মন্তব্যে স্পষ্টতই অসন্তুষ্টি ঝরে পড়েছে ধর্মীয় পোশাক বা পরিচয়ে টিভি বিতর্কে উপস্থিত থাকায়। দেবাংশুর অভিযোগ, এই কৌশলের মাধ্যমে দর্শকের ধর্মীয় অনুভূতির উপর প্রভাব ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। বিজেপি ‘সাধুদের’ সামনে বসিয়ে নিজের ভাবমূর্তি নির্মাণ করছে, যেখানে ‘মৌলবী’দের তৃণমূলপন্থী দেখিয়ে সংখ্যালঘু সমর্থন দেখানোর কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
তৃণমূলের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া
দেবাংশুর এই পোস্ট ঘিরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদিও প্রকাশ্যে মন্তব্য করেনি, তবে দলের অন্দরে এই ধরণের বিতর্কসভা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে। একাধিক তৃণমূল নেতা মনে করেন, মিডিয়ার একাংশ অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট এবং পরিকল্পিতভাবে তৃণমূলকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মুখে তুলে ধরলেও কার্যত বিরোধী পক্ষকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে।
একজন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূল নেতা বলেন, “ধর্মীয় পোশাক পরিহিত লোকদের দিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে অংশগ্রহণ করানো একটা ঘৃণ্য কৌশল। এতে করে দর্শকের মধ্যে আবেগীয় বিভ্রান্তি তৈরি হয়, যুক্তির জায়গা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।”
বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ
অন্যদিকে বিজেপি বলছে, তৃণমূলের এই বক্তব্য আসলে ধর্মীয় সহাবস্থানের বিরুদ্ধে। বিজেপির এক নেতা বলেন, “তৃণমূল এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে কেউ ধর্মীয় পোশাকে কথা বললেও তৃণমূল নেতাদের সমস্যা হয়। অথচ নিজেরাই মুসলিম তোষণ করে এসেছে বছরের পর বছর। এখন যেই হিন্দু সাধু গেরুয়া পরে কিছু বলল, সেটা বিজেপির চক্রান্ত! এটা হাস্যকর।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এটা গণতান্ত্রিক অধিকার—যে কেউ, যে ধর্মেরই হোক না কেন, টিভি চ্যানেলে মতামত রাখতে পারে। দেবাংশু ভট্টাচার্যের বক্তব্যে শুধু হীনমন্যতা নয়, অসহিষ্ণুতার পরিচয় মিলছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৌরভ পাল মনে করেন, “মিডিয়ার টক শোতে নানা মতের প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি। ধর্মীয় পোশাকের মধ্যে থেকেও কেউ রাজনৈতিক আলোচনা করতে পারেন, যদি তা যুক্তিনির্ভর হয়। কিন্তু যখন এই প্রতিনিধিত্ব পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় প্রতীকের মাধ্যমে বিভাজনের বার্তা দেয়, তখনই তা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”
তিনি আরও বলেন, “দেবাংশু ভট্টাচার্যের বক্তব্য এই দিকটাই ইঙ্গিত করছে। যদিও তার ভাষা বা টোন অনেকের কাছে বিতর্কিত ঠেকতে পারে, তবুও প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ—মিডিয়া কি দর্শকের আবেগ নিয়ে খেলছে?”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেবাংশুর এই পোস্টের পরেই মিলেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন, “তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত।” আবার কেউ কেউ কটাক্ষ করে লিখেছেন, “তৃণমূলের মুখপাত্র হয়ে কীভাবে সংবিধানের গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলেন তিনি?”
একজন টুইটার ব্যবহারকারী লেখেন, “ধর্মীয় পোশাক পরা মানেই যদি কারও রাজনৈতিক অধিকার না থাকে, তাহলে তো রাজনীতিতে সবাইকে ইউনিফর্ম পড়ে আসতে হবে!”
টিভি বিতর্কসভা কি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হয়ে উঠছে? সংবাদমাধ্যম কি নিরপেক্ষতার বাইরে গিয়ে দর্শকের আবেগকে প্রভাবিত করছে? দেবাংশুর পোস্ট এই প্রশ্নগুলোই সামনে নিয়ে এসেছে। তবে তাঁর বক্তব্যে যেভাবে ‘সাধু’ ও ‘মৌলবী’দের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে মন্তব্য করা হয়েছে, তা নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির নানা মহলে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক।
এই বিতর্ক আপাতত থামার নয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বরং রাজ্যের ভোট রাজনীতিতে ধর্মীয় চিত্রায়নের ইঙ্গিত আরও স্পষ্ট হচ্ছে বলেই তাঁদের মত।