পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর (Ram Navami) উৎসব এবার যেন রাজনীতির মঞ্চে পরিণত হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—রাজ্যের প্রতিটি কোণে রামনামে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মিছিলে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), এমনকি বামপন্থীদেরও দেখা গিয়েছে। তবে দিনের শেষে রামনবমীর রাজনৈতিক খেলায় তৃণমূল যেন বাকিদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়েছিল, তাতে তৃণমূলের এই আগ্রাসী অংশগ্রহণ অনেকেরই নজর কেড়েছে।
Ram Navami: রাজনীতির নতুন ময়দান
গত কয়েকদিন ধরে রামনবমীকে ঘিরে বঙ্গ রাজনীতিতে উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করে মঞ্চ গরম করে তুলেছিলেন। তিনি রামনবমীতে এক কোটি হিন্দুকে রাস্তায় নামার ডাক দিয়েছিলেন। পাল্টা জবাবে তৃণমূলের নেতারা সুর চড়িয়েছেন। তৃণমূলের একাংশের দাবি ছিল, রামনবমীর এই উৎসব বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাদের মতে, এটি বহিরাগত সংস্কৃতির প্রভাব। কিন্তু রবিবার যে চিত্র দেখা গেল, তাতে তৃণমূল নিজেই রামনবমীর উদযাপনে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে বিজেপির সঙ্গে জোর টক্কর দিয়েছে।
বাংলায় রামনবমীর এই রমরমা এক দশক আগেও এতটা লক্ষণীয় ছিল না। ২০১৬ সালে দিলীপ ঘোষ রাজ্য বিজেপির সভাপতি হন এবং বিধায়ক নির্বাচিত হন। তার পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সাল থেকে বাংলায় রামনবমী উদযাপনের প্রচলন শুরু হয়। বিজেপি এই উৎসবকে হিন্দুত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার শুরু করে। তৃণমূল তখন এই উদযাপনকে তীব্র কটাক্ষ করে। তাদের প্রচারে বলা হয়েছিল, “বাংলার রাম হলেন রাজা রামমোহন রায়” অথবা “বাঙালির রাম মানে রামকৃষ্ণ পরমহংস”। কিন্তু এই তত্ত্ব হিন্দু বাঙালির মনে খুব একটা জায়গা করে নিতে পারেনি। বিজেপি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোটের সমর্থন বাড়ানোর জন্য রামনবমীকে আরও জোরালোভাবে প্রচার করতে থাকে।
তৃণমূলের কৌশলগত পাল্টা
এই পরিস্থিতিতে হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে তৃণমূলও ময়দানে নামে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল নিজের জেলায় কীর্তন মিছিলের আয়োজন করেন। খোল-করতাল বিলি করে হিন্দু ভক্তদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তবে তখনও তৃণমূলের মধ্যে রামনাম নিয়ে একটা অনীহা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দল বুঝতে পারে যে, রামনবমীকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলে হিন্দু ভোটারদের একটা বড় অংশের সমর্থন হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এবার, ২০২৫ সালের রামনবমীতে তৃণমূল পুরোদমে এই উৎসবে যোগ দেয়।
রবিবার সেই অনুব্রত মণ্ডল বীরভূমে রামনবমীর মিছিলে হেঁটেছেন। রামের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন। একই ছবি দেখা গিয়েছে কলকাতায়। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির সামনে গেরুয়া মিছিলের সঙ্গে তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষকে দেখা গিয়েছে। তিনি গোলাপি পাগড়ি ও গোলাপি ওড়না পরে মিছিলে অংশ নেন। হাওড়ার সালকিয়ায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে তৃণমূল বিধায়ক গৌতম চৌধুরী পা মিলিয়েছেন। বরানগরে রামনবমীর শোভাযাত্রায় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এবং বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব সকালে রামের পুজো দিয়ে দিন শুরু করেন। শ্রীরামপুরে তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইসলামপুরে কানাইলাল আগরওয়ালার মতো নেতারাও রামনবমীর উৎসবে যোগ দিয়েছেন।
বিজেপির সঙ্গে টক্করে তৃণমূলের বাড়তি সুবিধা
রামনবমীতে বিজেপির নেতাদের উচ্ছ্বাস বরাবরই দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুভেন্দু অধিকারী, দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদারের মতো নেতারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু এবার তৃণমূলও একই পথে হেঁটেছে। মিছিল, স্লোগান, ডিজে বাজিয়ে নাচ—বিজেপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৃণমূলও উৎসবের রঙে মেতে উঠেছে। তবে তৃণমূলের মিছিলে একটি বাড়তি সংযোজন ছিল—‘খেলা হবে’ গান। এই গান তাদের প্রচারে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল এবার রামনবমীকে শুধু ধর্মীয় উৎসব হিসেবে নয়, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও ব্যবহার করেছে। বিজেপি যেখানে রামনবমীকে হিন্দুত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে, সেখানে তৃণমূল এটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা হিসেবে প্রচার করেছে। মিছিলে তৃণমূল নেতারা বারবার বলেছেন, “রাম কারও একার নয়, রাম সবার।” এই বার্তা হিন্দু ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর পাশাপাশি তাদের ধর্মনিরপেক্ষ ইমেজও বজায় রেখেছে।
রামনবমীর রাজনীতি: কে এগিয়ে?
দিনের শেষে রামনবমীর রাজনৈতিক মঞ্চে তৃণমূল যেন বিজেপির থেকে একটু এগিয়ে গিয়েছে। বিজেপি যেখানে রামনবমীকে নিজেদের ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, তৃণমূল সেখানে এই উৎসবকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বীরভূমে শতাব্দী রায়, মালদহে কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী, বাগবাজারে শশী পাঁজার মতো নেতারা রামনবমী পালন করে হিন্দু ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু নেতাও এই মিছিলে অংশ নিয়েছেন, যা তৃণমূলের সম্প্রীতির বার্তাকে আরও জোরালো করেছে।
অন্যদিকে, বিজেপি তাদের ঐতিহ্যবাহী শক্তি প্রদর্শন করলেও তৃণমূলের এই আগ্রাসী অংশগ্রহণ তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ধরনের উৎসব রাজনীতির ময়দানে বড় ভূমিকা পালন করবে। রামনবমীর এই খেলায় তৃণমূলের বাজিমাত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাম বা রামনবমী আর শুধু বিজেপির একচেটিয়া নয়। বাংলার রাজনীতিতে রামনাম এখন সবার মুখে।