বাঙালি আবেগে শান দিতে সংঘের অস্ত্র মহালয়া

বাংলার সংস্কৃতিতে মহালয়ার দিনটির তাৎপর্য অসামান্য। বাঙালির আবেগ, ধর্মীয় অনুভব ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ এই দিন। ঠিক এই আবেগকেই হাতিয়ার করে বাংলায় নিজেদের সংগঠন…

RSS Launches Hindu Jagran Abhiyan in Bengal Using Mahalaya to Promote Hindu Unity and Cultural Revival

বাংলার সংস্কৃতিতে মহালয়ার দিনটির তাৎপর্য অসামান্য। বাঙালির আবেগ, ধর্মীয় অনুভব ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ এই দিন। ঠিক এই আবেগকেই হাতিয়ার করে বাংলায় নিজেদের সংগঠন মজবুত করতে বড় কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS)।

সংঘের তরফে জানানো হয়েছে, মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হবে “হিন্দু জাগরণ অভিযান” (Hindu Jagran Abhiyan)। সেই সূত্র ধরেই এ বছর বিজয়া দশমী থেকে আগামী বছরের বিজয়া দশমী পর্যন্ত গোটা এক বছর বাংলায় চলবে RSS-এর বিস্তৃত প্রচার কার্যক্রম। এই এক বছরের লক্ষ্য— হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা, বাংলার হিন্দু সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করা, আর সেই সঙ্গে সংঘের সাংগঠনিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলা।

   

মহালয়া: আবেগের দিনে সংঘের প্রথম অস্ত্রোপচার
মহালয়া মানেই বাঙালির মন ও মননে দেবীপক্ষের সূচনা। এদিন সূর্য ওঠার আগেই গঙ্গার ঘাটে, বাড়ির বারান্দায় কিংবা রেডিওর সামনে বসে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র শুনে আবেগে ভেসে ওঠে বহু পরিবার। ঠিক এই আবেগেই শান দিতে চাইছে RSS।

মহালয়ার দিন বাংলার বহু শহর ও গ্রামের রাস্তায় বেরোবে সংঘের ‘পথসঞ্চালন’। স্বয়ংসেবকরা হাফ প্যান্ট, সাদা জামা পরে হাতে পতাকা ও ব্যান্ড বাজিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে মিছিল করবেন। এই জনসমাগমে চোখ রাখবে শুধু হিন্দু সমাজই নয়, প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলও।

২০০০ হিন্দু সম্মেলনের মাধ‍্যমে বিস্তৃত পরিকল্পনা
RSS সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী এক বছরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করা হবে অন্তত ২০০০ হিন্দু সম্মেলনের। এই সম্মেলনগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় চর্চা বা পুরাণ পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এখানে আলোচনা হবে হিন্দু সমাজের চ্যালেঞ্জ, ধর্মান্তরণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ঐতিহ্য হারানোর আশঙ্কা, এবং নতুন প্রজন্মের কাছে হিন্দু সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়ে।

সেই সঙ্গে প্রতিটি সম্মেলনে স্থানীয় নেতৃত্বকে সক্রিয় করা হবে এবং নতুন স্বয়ংসেবক তৈরির লক্ষ্যে সাংগঠনিক রূপ দেওয়া হবে।

“প্রতি ঘর, প্রতি পাড়া, প্রতি গ্রাম”: বাংলায় RSS-এর মডেল
RSS যে শুধু শহুরে এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, তা স্পষ্ট এই নতুন মডেল থেকে। “প্রতি ঘর, প্রতি পাড়া, প্রতি গ্রাম” মডেল অর্থাৎ বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে, বাড়িতে বাড়িতে RSS-এর স্বয়ংসেবকরা পৌঁছে যাবেন।

তাঁরা হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনোজগতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন। সংস্থার মতে, বহু হিন্দু পরিবার আজ বিভ্রান্ত, বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে ঐক্য ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।

Advertisements

২২ আগস্ট বাংলায় RSS সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবলের সফর
RSS-এর এই বৃহৎ কর্মসূচির তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য ২২ আগস্ট বাংলায় আসছেন সংঘের সর্বভারতীয় সরকার্যবাহ দত্তাত্রেয় হোসবলে। তিনি কলকাতা সহ একাধিক জেলায় সংগঠনের কার্যক্রম ঘুরে দেখবেন এবং বাংলার জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশ দেবেন।

সূত্রের দাবি, হোসবলের সফরকালে নতুন জেলা ও ব্লক পর্যায়ে RSS শাখা খোলার নির্দেশ আসতে পারে। পাশাপাশি সংঘের সহযোগী সংগঠন গুলিকেও ময়দানে নামানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

রাজনৈতিক বার্তাও স্পষ্ট
RSS-এর হিন্দু জাগরণ অভিযানে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তাও রয়েছে। তারা মনে করে, বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলায় হিন্দুদের ‘নীরব দর্শক’ করে রাখা হয়েছে।

RSS নেতৃত্বের বক্তব্য, “আমরা রাজনীতি করি না, কিন্তু সমাজের সংগঠন না থাকলে সংস্কৃতিও থাকবে না। বাংলায় হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য।”

বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া
এই বৃহৎ কর্মসূচিকে ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজনীতির ময়দানে শোরগোল শুরু হয়েছে। তৃণমূল ও বাম নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, RSS আসলে বাংলায় মেরুকরণ ঘটাতে চাইছে। তাঁদের মতে, মহালয়া কিংবা বিজয়া দশমীর মতো আবেগঘন উৎসবকে ধর্মীয় রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত করছে সংঘ পরিবার।

যদিও সংঘের পালটা যুক্তি, “আমরা কাউকে আঘাত করতে চাই না। বরং হিন্দুদের মধ্যে আত্মপরিচয় ফিরিয়ে আনতে চাই। বিভাজনের রাজনীতি করছে যারা ধর্মীয় পরিচয় অস্বীকার করে।”

বাংলার মাটিতে মহালয়াকে সামনে রেখে RSS-এর এই বৃহৎ কর্মসূচি নিঃসন্দেহে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। বাঙালির আবেগকে সামনে রেখেই সংঘ এবার হিন্দু সমাজে ঢুকতে চাইছে গভীরে। এ যাত্রা কতদূর যাবে, তা সময় বলবে, তবে মহালয়া যে এবার শুধু রেডিওর স্পিকারে নয়, রাজনীতির কানে কানে বেজে উঠবে— তা বলাই যায়।