কলকাতার লেদার কমপ্লেক্সে ম্যানহোলে পড়া শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাটি সম্প্রতি দেশের মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনায় একদিকে যেমন শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও একবার সামনে এসেছে, তেমনই অন্যদিকে রাজ্য সরকারের মধ্যে একটি বিতর্কের সূচনা হয়েছে। এক দিকে, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে দেশের বড় শহরগুলিতে ম্যানহোল পরিষ্কার করতে গিয়ে শ্রমিকদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেখানে কলকাতায় এরকম এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটা একধরণের অবহেলার ইঙ্গিত দেয়।
মানুষের জীবন সুরক্ষিত রাখার জন্য কত আইন ও নিয়ম থাকলেও, ক্ষেত্রবিশেষে এর বাস্তবায়ন ঠিকভাবে না হওয়ায় এমন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে। কলকাতার লেদার কমপ্লেক্স থানার ওই ঘটনায় ম্যানহোলে কাজ করতে নামা তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর, পুরো রাজ্যজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার পরপরই, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি হয় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রীসভায় উপস্থিত হয়ে নিজের ক্ষোভ উগরে দেন বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের মন্ত্রী জাভেদ খানের উপর। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল, তার দায় দায়ী করা উচিত। কিন্তু, চাপে পড়া মন্ত্রী জাভেদ খান তার দফতরের কোনও দায় নিতে অস্বীকার করেন। তিনি পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেন, এই কাজের সঙ্গে তার দফতরের কোন সম্পর্ক নেই। এরপরই, পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে একরকম বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ দেন, যে বিষয়টির ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করা হবে। তবে, তদন্তটি কিভাবে এবং কোন দফতরের অধীনে হবে, সে বিষয়ে কিছু স্পষ্ট নির্দেশনা দেননি তিনি। এমনকি, এই ঘটনার পরই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেন, যা অবশ্যই একটি দুঃখজনক ও মানবিক পদক্ষেপ, কিন্তু, যে ঘটনার জন্য সেই ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে, তা নিয়ে রাজ্যবাসী গভীর চিন্তায় পড়েছেন।
রাজ্যের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন। একদিকে, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন এত অপ্রতুল? অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও কেন আইন অমান্য করে কাজ করতে দেওয়া হলো? এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটছে, তখন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও দফতরের মধ্যে দায়বদ্ধতা এবং তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন ওঠে, সরকারের তরফ থেকে কি সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? মন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা না থাকার ফলে, সরকারের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয় যে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, জীবনের মূল্য কতটা কম হয়ে যেতে পারে। তবে, মন্ত্রীরা যখন একে অপরকে দায়ী করার মধ্যে নিমজ্জিত, তখন জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে।
পরিশেষে, একথা বলা যেতে পারে যে, রাজ্যের প্রতিটি স্তরে কর্তৃপক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। শ্রমিকদের জীবন সুরক্ষিত রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ এবং সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। শুধু ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করলেই দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না, সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই জরুরি। সরকারের উচিত, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দ্রুত নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা পুনরায় না ঘটে।