রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার দাবি জানিয়েছেন, গঙ্গাসাগর মেলাকে (Gangasagar Mela) জাতীয় মেলা হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তাঁর বক্তব্য, যেমন কুম্ভ মেলা জাতীয় মর্যাদা পেয়েছে, তেমনভাবেই গঙ্গাসাগর মেলাও ভারতের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পর্যটনের ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সোমবার লোকসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের জবাব স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আপাতত এমন কোনও পরিকল্পনা নেই। ফলে ফের একবার কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে ঘিরে রাজনীতির মঞ্চে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠল।
লোকসভায় তৃণমূল সাংসদ বাপি হালদার এদিন লিখিত প্রশ্ন করেন— গঙ্গাসাগর মেলাকে(Gangasagar Mela) কি কেন্দ্রীয় সরকার ‘জাতীয় মেলা’র স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী? এর উত্তরে কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত সাফ জানিয়ে দেন, এ ধরনের কোনও পরিকল্পনা সরকারের নেই। এই জবাব প্রকাশ্যে আসতেই তৃণমূল শিবিরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সাংসদ বাপি হালদার কেন্দ্রকে ‘বাংলা-বিরোধী’ বলে আক্রমণ করেন।
এর আগে একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কুম্ভ মেলার সঙ্গে তুলনা টেনে গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন। তাঁর মতে, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত, সাধু-সন্ন্যাসীর সমাগম হয় গঙ্গাসাগরে। এই মেলা শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতীকও বটে। কিন্তু কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আজও গঙ্গাসাগর উপেক্ষিত।
অভিযোগ, কুম্ভ মেলার জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দ করে কেন্দ্রীয় সরকার, অথচ গঙ্গাসাগরের ক্ষেত্রে তেমনটা করা হয় না। তৃণমূল সাংসদদের বক্তব্য, বাংলার প্রতি বৈমাতৃসুলভ আচরণের জেরেই এই সিদ্ধান্ত। তাঁদের দাবি, গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব কোনও অংশেই কম নয়। তবু এই মেলাকে জাতীয় মেলার তকমা না দেওয়া আসলে কেন্দ্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ।
উল্লেখযোগ্য, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি শেষ হয়েছে গঙ্গাসাগর মেলা(Gangasagar Mela) । সরকারি হিসেবে, এবার প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ ভক্ত গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নান করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, প্রশাসন, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একযোগে মেলাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার কাজে যুক্ত ছিল। পরিবেশ সচেতনতার জন্য এ বছর সাগরদ্বীপের রাস্তায় ১০০টি সৌরবিদ্যুৎচালিত আলো বসানো হয়। মেলাকে দূষণমুক্ত রাখতে প্লাস্টিক বোতল কাটার চারটি মেশিন বসানো হয়েছিল। সমুদ্রতট পরিষ্কার রাখতে তিন হাজার সৈকতপ্রহরী নিয়োগ করা হয়েছিল। ফলে গোটা আয়োজন হয়ে উঠেছিল আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব।
কেন্দ্রের এই অবস্থানের পর রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশিষ্ট মহলের একাংশ মনে করছেন, গঙ্গাসাগরকে অবহেলা করলে ভারতের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলার ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতা যে কতটা গভীরভাবে এই মেলার সঙ্গে যুক্ত, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
একইদিন রাজ্যসভায় তৃণমূল সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন। তিনি জানতে চান, বাংলাদেশের সঙ্গে জলবণ্টনের কারণে গঙ্গার চরিত্রে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কিনা। জলশক্তি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী রাজভুষণ চৌধুরী জবাবে জানান, এ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। যদিও তৃণমূল সাংসদেরা দাবি করেছেন, বাস্তবে গঙ্গার প্রবাহ ও চরিত্রে পরিবর্তন ধরা পড়ছে, যা বাংলার পরিবেশ ও কৃষির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে, গঙ্গাসাগর মেলাকে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি না দেওয়ার ঘটনায় ফের কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে গেল। তৃণমূলের দাবি, এই সিদ্ধান্ত বাংলার প্রতি কেন্দ্রের অবহেলা ও বিদ্বেষের আরেকটি নজির। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট— আপাতত গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। এই টানাপোড়েনের ভবিষ্যৎ রাজনীতি এবং প্রশাসনিক প্রভাব কী হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।