সম্পর্ক নির্ধারণে অর্থনৈতিক স্বার্থ, ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়: বিকাশরঞ্জন

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক তীর্যক মন্তব্য করে ফের শিরোনামে সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য (Bikash Ranjan Bhattacharya)। রবিবার সকালে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি এক বিস্ফোরক…

Bikash Ranjan Bhattacharya Slams Sanatani Support for Trump

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে রাজনৈতিক তীর্যক মন্তব্য করে ফের শিরোনামে সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য (Bikash Ranjan Bhattacharya)। রবিবার সকালে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি এক বিস্ফোরক পোস্ট করেন, যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের তথাকথিত ‘সনাতনী’ গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেন।

   

বিকাশবাবু লেখেন—“মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হলে তথাকথিত সনাতনী রামদেব, ইত্যাদি, উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন, সনাতনীদের জয়। ট্রাম্পের জয়ের বাসনায় তাঁরা যজ্ঞ করেছিলেন। ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান কি তবে সনাতনী অবস্থান? ভারত বিরোধীতা কি সনাতনী? সনাতনীরা বুঝুন, সম্পর্ক নির্ধারণে অর্থনৈতিক স্বার্থ কাজ করে, ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়। আমি নিশ্চিত, তথাকথিত সনাতনীরা যুক্তির বদলে খিস্তি শুরু করবেন।”

পটভূমি ও প্রসঙ্গ

ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম রাষ্ট্রপতি মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে একাধিক আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঘনিষ্ঠতা প্রদর্শন করেছিলেন। “Howdy Modi” বা “Namaste Trump” অনুষ্ঠানের মতো জনসমাগমে দুই নেতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উপস্থিতি সেই সময়ে দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। এই পর্বে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর একাংশ ট্রাম্পকে ‘সনাতনীদের বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিল, এমনকি তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের জন্য ভারতে যজ্ঞ ও পূজার আয়োজনও হয়েছিল।

কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের উপর একাধিক বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ ও শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। বিশেষত ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, টেক্সটাইল এবং কিছু কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত সরাসরি ভারতের রপ্তানি বাজারকে আঘাত করেছে। এতে ভারতীয় অর্থনীতির একাংশে চাপ তৈরি হয়েছে এবং দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিকাশরঞ্জনের তির্যক বার্তা

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক কটাক্ষ নয়; এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতার এক সোজাসাপ্টা মূল্যায়ন। তাঁর মতে, কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দেশের শাসক কখনোই শুধুমাত্র ধর্মীয় বা ভাবাবেগী কারণে সিদ্ধান্ত নেন না। বরং অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং কৌশলগত প্রয়োজনই নীতি নির্ধারণের মূল কারণ।

তাই তাঁর প্রশ্ন—যখন ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক বাড়াচ্ছেন বা বাণিজ্যে চাপ সৃষ্টি করছেন, তখন কি ‘সনাতনী’ সমর্থকরা এখনও তাঁকে সমর্থন করবেন? নাকি সেই সময় তাঁরা ট্রাম্পকে ‘ভারত বিরোধী’ বলে চিহ্নিত করবেন? বিকাশবাবুর বক্তব্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ধর্মীয় আবেগ দিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ব্যাখ্যা করা ভুল ও অযৌক্তিক।

Advertisements

অর্থনীতি বনাম আবেগ

বিশ্লেষকদের মতে, বিকাশবাবুর মন্তব্য আসলে ভারতীয় রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত একটি প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করছে—বিদেশ নীতিকে ধর্মীয় বা মতাদর্শগত রঙে দেখা। ইতিহাস সাক্ষী, যেকোনো দেশের শাসক প্রথমে নিজের দেশের স্বার্থই অগ্রাধিকার দেন। সেই স্বার্থ যদি মেলে, তবেই বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়। না মিললে, সম্পর্ক ঠান্ডা হয়ে যায়—যতই পূর্বে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য বা জনসমক্ষে বন্ধুত্বের প্রদর্শন থাকুক না কেন।

ট্রাম্পের শুল্কনীতি স্পষ্টভাবে “America First” দর্শনের প্রতিফলন। এই নীতিতে মার্কিন অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান রক্ষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, অন্য দেশের সঙ্গে ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠা গৌণ। তাই তাঁর প্রশাসন ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে দ্বিধা করছে না।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বিকাশরঞ্জনের মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক শুরু হয়। বামপন্থী সমর্থকরা তাঁর বক্তব্যকে ‘বাস্তববাদী’ ও ‘যুক্তিসঙ্গত’ বলে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদী সমর্থকদের একাংশ অভিযোগ তুলেছেন যে, বিকাশবাবু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘সনাতনী’দের অপমান করেছেন এবং রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন।
কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বিকাশরঞ্জনের বক্তব্য মূলত জনগণকে সতর্ক করার চেষ্টা—আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আবেগের স্থান সীমিত, আর অর্থনৈতিক স্বার্থই আসল চালিকা শক্তি।

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের পোস্ট আবারও মনে করিয়ে দিল, বিশ্ব রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু নেই। রয়েছে কেবল পারস্পরিক স্বার্থের সমীকরণ। ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান তারই প্রমাণ—পূর্বে তিনি ভারতের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হলেও, আজ তিনি ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে চাপ সৃষ্টি করতে পিছপা নন।

প্রশ্ন এখন একটাই—যাঁরা ট্রাম্পকে ‘সনাতনীর জয়ের প্রতীক’ বলে মানতেন, তাঁরা কি এখনো সেই সমর্থন বজায় রাখবেন, নাকি অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে নেবেন? বিকাশবাবুর ভাষায়, হয়তো উত্তর না দিয়ে তাঁরা শুধু খিস্তিতেই ব্যস্ত হবেন।