কার্সিয়াঙের ‘মাকাইবাড়ি চা বাগানে’র প্রাচীন ইংরেজ সাহেবদের গল্প

দার্জিলিংয়ের কার্সিয়াং-এর পাহাড়ের কোলে অবস্থিত মাকাইবাড়ি চা বাগান (Makaibari Tea Estate) শুধুমাত্র তার উৎকৃষ্ট চায়ের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের জন্যও।…

Untold Stories of British Sahibs at Makaibari Tea Estate in Darjeeling’s Kurseong

দার্জিলিংয়ের কার্সিয়াং-এর পাহাড়ের কোলে অবস্থিত মাকাইবাড়ি চা বাগান (Makaibari Tea Estate) শুধুমাত্র তার উৎকৃষ্ট চায়ের জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের জন্যও। ১৮৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চা বাগানটি ভারতের প্রাচীনতম চা বাগানগুলির মধ্যে একটি এবং এটি বিশ্বের প্রথম চা কারখানার গর্ব বহন করে। এই বাগানের ইতিহাস ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেখানে ইংরেজ সাহেবদের জীবনযাত্রা, শ্রমিকদের শোষণ এবং চা শিল্পের উত্থানের গল্প লুকিয়ে আছে। মাকাইবাড়ি, যার নামের অর্থ ‘ভুট্টার জমি’, ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একটি জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষী।

ব্রিটিশ সাহেবদের আগমন ও চা বাগানের শুরু
১৮৫২ সালে মাকাইবাড়ি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্যাপ্টেন স্যামলার, যিনি দার্জিলিং টি কোম্পানির এজেন্ট ছিলেন। তবে, অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এই বাগানটি বিক্রি করে দেন গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জির কাছে, যিনি কার্সিয়াং-এ একটি কমিসারি এবং ডাক পরিষেবা পরিচালনা করতেন। ব্রিটিশরা দার্জিলিংকে একটি হিল স্টেশন হিসেবে গড়ে তুলেছিল এবং চা চাষের সম্ভাবনা দেখে এই অঞ্চলে বিনিয়োগ শুরু করে। মাকাইবাড়ি ছিল তাদের প্রথম দিকের সফল প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে একটি। ১৮৫৯ সালে এখানে প্রথম চা কারখানা স্থাপিত হয়, যা দার্জিলিংয়ের চা শিল্পের জন্য একটি মাইলফলক ছিল। ব্রিটিশ সাহেবরা, যাদের মধ্যে অনেকে ‘বড় সাহেব’ এবং ‘ছোট সাহেব’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এই বাগানগুলির পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তাঁদের বিলাসবহুল বাংলোগুলো, যেমন মাকাইবাড়ির স্টোন হাউস, ব্রিটিশ রাজের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রতীক ছিল। এই বাংলোগুলোতে তারা শুধু বসবাসই করতেন না, বরং সামাজিক সমাবেশ, চা-পানের আড্ডা এবং শিকারের আয়োজন করতেন।

   

শ্রমিকদের জীবন ও শোষণের গল্প
ব্রিটিশ সাহেবদের জীবনযাত্রা যেমন বিলাসবহুল ছিল, তেমনি চা বাগানের শ্রমিকদের জীবন ছিল দুঃখ-দুর্দশায় ভরা। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার দাসপ্রথা বিলুপ্ত করলেও, চা বাগানে শ্রমিকদের ‘ইনডেনচারড লেবার’ হিসেবে কাজে নিয়োজিত করা হতো। এই শ্রমিকরা, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নেপাল, সিকিম এবং ভুটান থেকে আগত গোর্খা ও লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষ, দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতেন। তাদের কাজের পরিবেশ ছিল কঠিন, এবং জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত নিম্ন। ব্রিটিশ সাহেবরা শ্রমিকদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন, এবং অনেক সময় তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হতো। মাকাইবাড়ির শ্রমিকদের গল্পে এই শোষণের ছাপ স্পষ্ট। তবে, গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জির হাতে বাগানের মালিকানা আসার পর শ্রমিকদের কাজের পরিবেশে কিছুটা উন্নতি হয়। তিনি শ্রমিকদের জন্য আরও ন্যায্য ব্যবস্থা প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন, যা ব্রিটিশ শাসনের অন্যান্য চা বাগানের তুলনায় ব্যতিক্রমী ছিল।

মাকাইবাড়ির ঐতিহ্য ও আধুনিকতা
মাকাইবাড়ি চা বাগান শুধুমাত্র তার ইতিহাসের জন্যই নয়, বরং এর অগ্রগামী উদ্যোগের জন্যও বিখ্যাত। ১৯৮৮ সালে এটি বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব চা বাগান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্বরাজ কুমার ব্যানার্জি, যিনি ‘রাজা ব্যানার্জি’ নামে পরিচিত, এই বাগানের চতুর্থ প্রজন্মের মালিক ছিলেন। তিনি জৈব চাষ এবং বায়োডাইনামিক কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন করে মাকাইবাড়িকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেন। তাঁর নেতৃত্বে মাকাইবাড়ি বিশ্বের প্রথম ফেয়ার ট্রেড সার্টিফিকেশন পায় এবং ২০১৭ সালে এর প্রথম ফ্লাশ হস্তনির্মিত চা প্রতি কেজি ২১,৭৪৬ টাকায় বিক্রি হয়, যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রথম ফ্লাশ চা। এই বাগানের সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল এবং মাসকাটেল চা বিশ্বব্যাপী চা প্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

Advertisements

ব্রিটিশ সাহেবদের সময়ে মাকাইবাড়ি ছিল একটি বিলাসবহুল জীবনযাত্রার কেন্দ্র। তাঁরা এখানে বড় বড় বাংলোতে থাকতেন, যেখানে প্রকৃতির মাঝে বিলাসিতা এবং ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রার মিশ্রণ ছিল। ব্রিটিশরা চা বাগানকে শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যেই নয়, বরং তাদের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করতেন। মাকাইবাড়ির স্টোন হাউস এবং অন্যান্য বাংলোগুলোতে তারা চা-পানের আড্ডা, শিকার, এবং সামাজিক সমাবেশের আয়োজন করতেন। এই বাংলোগুলো আজও পর্যটকদের জন্য হোমস্টে হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে তারা ব্রিটিশ যুগের ঐতিহ্যের স্বাদ পান।

শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা
মাকাইবাড়ির ইতিহাসে শ্রমিকদের প্রতি দায়বদ্ধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালে স্বরাজ কুমার ব্যানার্জি তাঁর ১২% শেয়ার শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করেন, যা চা শিল্পে একটি বিরল উদাহরণ। তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে পরিবারের মতো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, যা ব্রিটিশ শাসনের সময়কার শোষণের বিপরীতে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাগানে শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা, এবং অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা হয়, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।

মাকাইবাড়ি চা বাগান শুধুমাত্র একটি চা উৎপাদন কেন্দ্র নয়, বরং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের ইতিহাস, শ্রমিকদের সংগ্রাম, এবং আধুনিক জৈব চাষের একটি জীবন্ত সাক্ষ্য। ব্রিটিশ সাহেবদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং শ্রমিকদের শোষণের গল্প এই বাগানের ইতিহাসের একটি অংশ, যা আজও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মাকাইবাড়ির হোমস্টে, চা টেস্টিং সেশন, এবং কারখানা ট্যুর পর্যটকদের জন্য একটি অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করে, যেখানে তারা ব্রিটিশ যুগের ঐতিহ্য এবং দার্জিলিং চায়ের জাদু উপভোগ করতে পারেন৷