মাত্র ১৭ বছর বয়সেই এক নজিরবিহীন উদ্ভাবন করে নজর কেড়েছে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুহানি চৌহান। ‘সো-অ্যাপ্ট অ্যাগ্রো ভেহিকল’ (So-Apt Agro vehicle) নামের একটি সৌরশক্তি-চালিত কৃষিযন্ত্র (Solar-powered agro vehicle) তৈরি করে সে দেখিয়েছে কিভাবে কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়। এই যন্ত্রটি শুধুমাত্র কৃষকদের সাহায্য করবে না, বরং পরিবেশে শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
একটি ক্ষুদ্র উদ্যোগের মহৎ যাত্রা
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মানেসরের একটি কৃষি ক্ষেত্র ভ্রমণে গিয়ে সুহানির জীবনে এই যন্ত্র তৈরির বীজ রোপিত হয়েছিল। সেই সময় সে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনা দেখে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। “কৃষকদের প্রতি সহানুভূতির পাশাপাশি আমি বুঝতে পারি তাদের জন্য কিছু করা প্রয়োজন। তখনই এই যন্ত্র তৈরির ভাবনা মাথায় আসে,” বলে সুহানি।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি ধারণা তার মনে আসে। কাগজে নিজের ভাবনা এঁকে স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকের কাছে নিয়ে যায় সে। পরবর্তীতে, সেই ধারণা বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করে।
সো-অ্যাপ্ট ভেহিকলের বৈশিষ্ট্য
সো-অ্যাপ্ট ভেহিকল হলো একটি বহু-কার্যক্ষম সৌরচালিত কৃষিযন্ত্র। এটি ফসলের গর্ত খোঁড়া, বীজ বপন, সেচ এবং সার ছিটানোর মতো কাজ করতে সক্ষম। এটি কৃষকদের জন্য একাধিক যন্ত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে।
যেখানে প্রচলিত ট্রাক্টরের দাম ৫ লক্ষ টাকার বেশি, সেখানে সো-অ্যাপ্ট ভেহিকলের দাম মাত্র ২ লক্ষ টাকা। এটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কৃষকদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। সুহানি বলেন, “মাস প্রোডাকশনের মাধ্যমে এই দাম আরও কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে এটি আরও বেশি কৃষকের নাগালের মধ্যে আসে।”
এই যন্ত্রটি সম্পূর্ণরূপে সৌরশক্তি দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় এটি ডিজেলের ব্যয় কমাবে এবং পরিবেশবান্ধব হবে। এর সঙ্গে একটি ব্যাকআপ ইঞ্জিনও রয়েছে, যা বর্ষাকালে বা রাতে যন্ত্রটিকে কার্যক্ষম রাখবে।
সফরের চ্যালেঞ্জ ও সমর্থন
সো-অ্যাপ্ট ভেহিকল তৈরির পথ সহজ ছিল না। নানা প্রযুক্তিগত সমস্যা, সময় ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সুহানিকে। তবে এই যাত্রায় তার পরিবার এবং স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
দক্ষিণ দিল্লির পুষ্পবিহারের অমিটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং নোয়ডার অমিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি মিটিং করে তাদের প্রয়োজন এবং চাহিদা বুঝে যন্ত্রটির ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়।
সুহানি বলেন, “কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা আমাকে জানায়, ভেহিকলের টায়ার এবং উচ্চতা বাড়ানোর প্রয়োজন। আমি সেই অনুযায়ী কাজ করছি।”
উদ্ভাবনের স্বীকৃতি
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সুহানি ভারতের সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার’ পান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সুহানি তার প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করেন এবং তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে সৌরশক্তি ব্যবহার বিষয়ে অনুপ্রেরণা পান।
সুহানির মা পূজা চৌহান বলেন, “আমাদের মেয়ের এই উদ্যোগ দেখতে পাওয়া আমাদের জন্য গর্বের। তার কঠোর পরিশ্রম এবং উদ্ভাবনী ভাবনা সার্থক হয়েছে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সুহানি বর্তমানে সো-অ্যাপ্ট ভেহিকলে জিপিএস এবং মাটি পরীক্ষা করার পিএইচ ক্যালকুলেটর যোগ করার কাজ করছে। “এই যন্ত্রটি আরও স্মার্ট এবং কৃষকদের ব্যবহারের উপযোগী করতে চাই,” বলে সুহানি। তার লক্ষ্য হলো যন্ত্রটি সারা ভারতের কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং প্রযুক্তিটি বৃহৎ কোম্পানিগুলোর কাছে হস্তান্তর করা।
সুহানি চৌহানের সো-অ্যাপ্ট ভেহিকল এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এটি শুধু কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করবে না, বরং পরিবেশের সুরক্ষায়ও অবদান রাখবে। তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি যে সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হতে পারে, তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হলো এই প্রকল্প।