OYO-র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রিতেশ আগরওয়াল (Ritesh Agarwal) নেতৃত্বের ক্ষেত্রে উদাহরণ স্থাপনের প্রতি বিশ্বাসী। সম্প্রতি মুম্বই টেক উইক-এ তিনি যে কথা প্রকাশ করেছেন, তা অনেককেই অবাক করেছে। ১ মার্চ এই সম্মেলনে বক্তৃতার সময় রিতেশ জানিয়েছেন যে, তিনি এখনও নিজের হোটেলের ওয়াশরুম পরিষ্কার করেন। এই অভ্যাস তাঁর হাতে-কলমে নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত। মাত্র ৩০ বছর বয়সে OYO-কে ৮০টি দেশে ১০ লক্ষেরও বেশি কক্ষ সহ একটি বিশ্বব্যাপী আতিথেয়তা সংস্থায় রূপান্তরিত করা এই উদ্যোক্তা এই প্রসঙ্গে ব্যর্থতার ভয় কীভাবে কাটিয়ে উঠতে হয়, তা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
নেতৃত্বে ব্যক্তিগত বাধা অতিক্রমের গুরুত্ব
রিতেশ আগরওয়াল উদ্যোক্তা হিসেবে সাফল্যের জন্য ব্যক্তিগত বাধাগুলো অতিক্রমের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, সাফল্যের জন্য প্রথম দিন থেকেই ভয়, লজ্জা, অহংকার এবং দম্ভ ত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন, “একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম দিনে আপনাকে ভয়, লজ্জা, অহংকার, দম্ভ—সবকিছু—ঘরের বাইরে রেখে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে, কারণ এগুলোই উদ্যোক্তা সাফল্যের সবচেয়ে বড় শত্রু।” তিনি আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে, মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “আপনি কি গর্বের খোঁজে আছেন, না সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে?” তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “আমি খুব পরিষ্কার যে আমি একটি বড় প্রভাব সৃষ্টি করতে চাই।”
রিতেশের এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, তাঁর ব্যবসায়িক দর্শনেও প্রতিফলিত হয়। তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে কর্মীদের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করতে চান। ওয়াশরুম পরিষ্কার করার মতো কাজকে তিনি ‘রোল মডেলিং’ হিসেবে দেখেন, যা তাঁর দলের মধ্যে নম্রতা ও কর্মঠতার বার্তা পৌঁছে দেয়।
পরিচ্ছন্নতার প্রতি অঙ্গীকার
রিতেশ আগরওয়ালের পরিচ্ছন্নতার প্রতি প্রতিশ্রুতি নতুন কিছু নয়। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে তিনি OYO সম্পত্তিগুলোর পরিচ্ছন্নতার মান বাড়াতে ‘স্পটলেস স্টে’ নামে একটি উদ্যোগ চালু করেছিলেন। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে নির্দিষ্ট অফিসাররা প্রতিদিন হোটেলে গিয়ে পরিদর্শন করতেন এবং রিতেশ নিজেও এই কাজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন যে, OYO-র হোটেলগুলোতে অতিথিরা উচ্চমানের পরিচ্ছন্নতার অভিজ্ঞতা পান। এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি হোটেল মালিকদের সঙ্গে মিলে কাজ করে পরিচ্ছন্নতার মান উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। রিতেশ বলেছিলেন, “আমরা শীঘ্রই ৩,০০০-এর বেশি পরিদর্শন শুরু করছি এবং অক্টোবরের মধ্যে এটি ৬,০০০-এর বেশি করার লক্ষ্য রাখছি।”
তাঁর এই হাতে-কলমে অংশগ্রহণ শুধু পরিচ্ছন্নতার প্রতি তাঁর নিষ্ঠার প্রমাণ নয়, বরং তাঁর দলের মধ্যে একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াস। তিনি বিশ্বাস করেন যে, নেতৃত্ব শুধু নির্দেশ দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং কাজের মাধ্যমে পথ দেখানোটাই আসল নেতৃত্ব।
উদ্যোক্তা জীবনে রিতেশের পথচলা
রিতেশ আগরওয়ালের জীবন একটি প্রেরণাদায়ী গল্প। ১৯৯৩ সালে ওড়িশার বিসম কটক-এ একটি মারওয়াড়ি পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রিতেশ তিতিলাগড়ে বড় হয়েছেন। তাঁর পরিবার রায়গড়ায় একটি ছোট দোকান চালাত। ২০১১ সালে দিল্লিতে কলেজে পড়তে এসে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পা বাড়ান। ২০১২ সালে তিনি ‘ওরাভেল স্টেস’ নামে একটি সংস্থা শুরু করেন, যা পরে ২০১৩ সালে ‘OYO’ নামে পরিচিত হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় তিনি বাজেট হোটেলের অভাব লক্ষ্য করেন এবং এই সমস্যার সমাধান হিসেবে OYO-র জন্ম দেন।
তাঁর প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। আজ OYO বিশ্বের অন্যতম বড় আতিথেয়তা চেইন, যা ৮০টি দেশে ১০ লক্ষেরও বেশি কক্ষ পরিচালনা করে। ২০২৪ সালের হুরুন রিচ লিস্টে তিনি ভারতের শীর্ষ ১০ তরুণ ধনকুবেরদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছেন। মাত্র ৩০ বছর বয়সে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ১,৯০০ কোটি টাকা।
নম্রতা ও প্রভাবের দর্শন
রিতেশের এই পদক্ষেপ তাঁর নম্রতা ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে, ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ও মানসিকতা প্রায়ই মানুষকে ছোট কাজ গ্রহণ করতে নিরুৎ সাহিত করে। তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষা আমাদের এটা শেখায় না যে, লজ্জা ত্যাগ করতে হবে এবং ‘এটা আমার কাজ, ওটা অন্যের কাজ’—এই ভাবনা ছেড়ে দিতে হবে।” তিনি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করেন যে, তারা যেন প্রতিটি কাজকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকেন, যত ছোটই হোক না কেন।
মুম্বই টেক উইক-এ তিনি ব্যর্থতার ভয় কাটিয়ে ওঠার উপায় নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “আমি যদি কলেজে যেতাম, তাহলে ভালো করতে পারতাম না। তাই আমি ঠিক করলাম, যদি পরিবার আমাকে দোষ দেবেই, তবে আমি এমন কিছু করব যা আমাকে উত্তেজিত করে।” এই মানসিকতাই তাঁকে OYO-র মতো একটি বিশ্বব্যাপী সংস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
ব্যবসায়িক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
OYO-র সাফল্য শুধু রিতেশের ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং ভারতীয় উদ্যোক্তাদের জন্য একটি উদাহরণ। ২০২৪ সালে OYO প্রথমবারের জন্য ২২৯ কোটি টাকার মুনাফা অর্জন করে, যা তাদের আর্থিক বছর ২০২৩-২৪-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া, কোম্পানির অ্যাডজাস্টেড EBITDA গত বছরের তুলনায় ২১৫% বেড়ে ৮৭৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
রিতেশের এই গল্প শুধু একজন উদ্যোক্তার সাফল্যের কাহিনী নয়, বরং নম্রতা, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রভাব সৃষ্টির প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের প্রতিফলন। হোটেলের ওয়াশরুম পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা পরিচালনা—রিতেশ আগরওয়াল প্রমাণ করেছেন যে, সাফল্যের পথে কোনো কাজই ছোট নয়।