কোচ রাজাদের পুরনো কয়েন, গ্রামের বৃদ্ধেরা আগলে রেখেছেন ঐতিহ্য

Koch Dynasty Ancient Coins: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার অঞ্চলের গ্রামগুলিতে একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আজও জীবন্ত রয়েছে। কোচ রাজবংশের পুরনো কয়েন, যা শতাব্দী আগের শাসনকালের…

Koch Dynasty Ancient Coins Preserved as Heritage by Village Elders

Koch Dynasty Ancient Coins: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার অঞ্চলের গ্রামগুলিতে একটি প্রাচীন ঐতিহ্য আজও জীবন্ত রয়েছে। কোচ রাজবংশের পুরনো কয়েন, যা শতাব্দী আগের শাসনকালের সাক্ষ্য বহন করে, গ্রামের বৃদ্ধেরা তাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতি হিসেবে যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এই কয়েনগুলি কেবল মুদ্রা নয়, বরং কোচ রাজবংশের গৌরবময় ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি জীবন্ত প্রমাণ। কোচবিহার, গোয়ালপাড়া, এবং অসমের কিছু অংশে এই কয়েনগুলি গ্রামবাসীদের কাছে ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে সম্মানিত। এই প্রতিবেদনে আমরা এই কয়েনগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তাদের সংরক্ষণ এবং গ্রামীণ সম্প্রদায়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

কোচ রাজবংশের ইতিহাস
কোচ রাজবংশ (১৫১৫-১৯৪৯) ভারতের পূর্বাঞ্চলের কমতা রাজ্যে শাসনকারী একটি শক্তিশালী রাজবংশ ছিল, যা বর্তমানের অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে বিস্তৃত ছিল। ১৪৯৮ সালে খেন রাজবংশের পতনের পর বিশ্ব সিংহ এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিভিন্ন বোডো জনগোষ্ঠী এবং স্থানীয় শাসকদের একত্রিত করে কমতা রাজ্যে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র নরনারায়ণ এবং সেনাপতি চিলারায়ের নেতৃত্বে কোচ রাজবংশ কামরূপ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল এবং দক্ষিণ অসমের কিছু অংশ দখল করে। এই সময়ে কোচবিহার এবং কোচ হাজো নামে দুটি শাখায় রাজবংশ বিভক্ত হয়, এবং কোচবিহার মুঘলদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনকালে কোচবিহার একটি প্রিন্সলি স্টেটে পরিণত হয় এবং ভারতের স্বাধীনতার পর এটি ভারতের অংশ হয়।

   

কোচ কয়েনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কোচ রাজবংশের শাসনকালে মুদ্রা বা কয়েন ছিল অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম। এই কয়েনগুলি সাধারণত রুপো এবং তামার তৈরি হতো এবং এতে রাজার নাম, রাজকীয় প্রতীক এবং কখনো কখনো সংস্কৃত বা স্থানীয় ভাষায় শিলালিপি খোদিত থাকত। এই কয়েনগুলি কেবল অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই নয়, বরং রাজবংশের ক্ষমতা, প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, নরনারায়ণের শাসনকালে মুদ্রিত কয়েনগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কয়েনগুলিতে প্রায়শই ‘শ্রী শ্রী নরনারায়ণ’ বা অন্যান্য রাজকীয় শিরোনাম খোদিত থাকত, যা রাজবংশের গৌরব প্রকাশ করত।

এই কয়েনগুলি কমতা রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের সাক্ষ্য বহন করে। এগুলি মুঘল, আহোম এবং অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যে ব্যবহৃত হতো। কোচবিহারের কিছু কয়েনে স্থানীয় শিল্প ও নকশার প্রভাবও দেখা যায়, যা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। এই কয়েনগুলি আজও ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

গ্রামের বৃদ্ধদের ভূমিকা
কোচবিহার, গোয়ালপাড়া, এবং অসমের গ্রামাঞ্চলে বৃদ্ধরা এই কয়েনগুলিকে তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য হিসেবে যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এই কয়েনগুলি প্রায়শই তাদের পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়েছে। গ্রামের বৃদ্ধরা এই কয়েনগুলিকে কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং তাদের পূর্বপুরুষের গৌরবময় অতীতের স্মৃতি হিসেবে দেখেন। কোচবিহারের কিছু গ্রামে, যেমন তুফানগঞ্জ বা দিনহাটার মতো অঞ্চলে, বৃদ্ধরা এই কয়েনগুলি তাদের ঘরের পূজার স্থানে বা বিশেষ বাক্সে রেখে দেন। কেউ কেউ এগুলি স্থানীয় উৎসবে প্রদর্শন করেন, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের ইতিহাস সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়।

এক্স-এ পোস্ট করা একটি সাম্প্রতিক আলোচনায়, কোচবিহারের একজন বাসিন্দা লিখেছেন, “আমার দাদুর কাছে একটি কয়েন ছিল, যেটি তিনি বলতেন নরনারায়ণের আমলের। এটি আমাদের পরিবারের গর্ব।” এই ধরনের গল্প গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। তবে, এই কয়েনগুলির সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আধুনিকীকরণ, শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কিছু পরিবার এই কয়েনগুলি বিক্রি করে দিয়েছে, যা ঐতিহ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

Advertisements

সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ ও সরকারি উদ্যোগ
কোচ রাজবংশের কয়েনগুলি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই কয়েনগুলির প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য থাকলেও, অনেক গ্রামবাসী এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত নন। ফলে, কিছু কয়েন কালোবাজারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে অনেক কয়েনের ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কয়েনগুলি আর্দ্রতা, ধুলো এবং অনুপযুক্ত সংরক্ষণের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও এই ঐতিহ্য রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কোচবিহার জেলা প্রশাসন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্থানীয় জাদুঘরে এই কয়েনগুলি সংরক্ষণের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ জাদুঘরে ইতিমধ্যে কিছু কয়েন প্রদর্শনের জন্য সংগ্রহ করেছে। এছাড়া, স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কর্মশালা এবং প্রচারণার আয়োজন করা হচ্ছে। সিসিএন বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কোচ নৃগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্য বজায় রাখতে সচেষ্ট, তবে শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তাদের প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য
কোচ রাজবংশের কয়েনগুলি কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এগুলি স্থানীয় সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের অংশ। এই কয়েনগুলি কোচ নৃগোষ্ঠীর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং তাদের শাসনকালের সাফল্যের প্রতীক। গ্রামের বৃদ্ধরা এই কয়েনগুলির মাধ্যমে তাদের ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই কয়েনগুলি স্থানীয় উৎসব, যেমন বিহু বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়, যা তরুণদের মধ্যে ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ জাগায়।

কোচবিহারের একজন ইতিহাসবিদ বলেন, “এই কয়েনগুলি কোচ রাজবংশের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রমাণ। এগুলি সংরক্ষণ করা আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার অংশ।” তবে, তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আধুনিকীকরণের ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ কমছে।

কোচ রাজবংশের পুরনো কয়েনগুলি কেবল ধাতব মুদ্রা নয়, এগুলি একটি গৌরবময় অতীতের সাক্ষ্য। গ্রামের বৃদ্ধরা এই কয়েনগুলিকে তাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আগলে রেখেছেন, যা তাদের পূর্বপুরুষের গল্প বহন করে। তবে, এই ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগের প্রয়োজন। স্থানীয় জাদুঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই কয়েনগুলি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হতে পারে। কোচ রাজবংশের এই ঐতিহ্য আমাদের ইতিহাসের একটি অমূল্য অধ্যায়, যা আগলে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।