সারা পৃথিবীতে একমাত্র নেপালের পশ্চিমে হিমালয়ের ১২৫০০ ফুট ওপরে, যেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় হাঁটা পথ, সেখানে গণ্ডকী বা কালী-গণ্ডকী নদীতে শালগ্রাম শিলা (Shaligram Shila) বা নারায়ণ শিলা পাওয়া যায়। ভূ-বিজ্ঞান অনুসারে হিমালয়ের চারটি স্তর। প্রথমটি হল, শিবালিক স্তর। তারপর লোয়ার-হিমালয় বা গণ্ডোয়ানা স্তর। এরপরে মূল হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল ; এই ঢালেই গণ্ডোয়ানা স্তরের পরেই বক্সা শ্রেণী এবং সব শেষে উচ্চ হিমালয় পর্বত—এভারেষ্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা ইত্যাদি।
আজকের হিমালয় একসময়ে ছিল সমুদ্রগর্ভে। আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে সেনোজয়িক কল্পে ইয়োসিন যুগের শেষ ভাগে, টেথিস সমুদ্র থেকে হিমালয় আস্তে আস্তে মাথা তুলতে শুরু করে আর তা শেষ হয় প্লাইস্টোসিন উপ-যুগে প্রায় এক কোটি বছর আগে। ফলে, এক মহা-অতীত কালের সামুদ্রিক পলিস্তর রূপান্তরিত হয়েছে আজকের হিমালয়ের শিলাস্তরে। হিমালয়ের এই শিলাস্তর কে বলা হয় “স্পিতি” শেল। খুব সুক্ষ্ম দানা পলি অবক্ষেপ থেকে তৈরী হয়েছে বলে বিজারক পরিবেশে সৃষ্ট এই শেল এত তৈলাক্ত ও কালো।
আজ থেকে আঠারো কোটি বছর আগে, জুরাসিক যুগে, যে সময়ে ডাঙ্গায় মানে পৃথিবীতে ডাইনোসরেরা রাজত্ব করছে, সেই সময়ে এই পলি অবক্ষেপ ঘটেছিল। তার বহু বহু কোটি বছর পরে সমুদ্রগর্ভ থেকে জন্ম নেয় হিমালয়। এর ফলে, আজকের হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত স্পিতি শেল শিলাস্তরে পাওয়া যায় জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক জীবের প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম। কালীগণ্ডকীর উৎপত্তিও সেই চিরতুষারাবৃত অঞ্চলেই। জলের তীব্র স্রোতে ওই শিলাস্তরের ক্ষয় হচ্ছে। ধুয়ে মুছে ভেঙে নিয়ে আসছে বলে কালীগণ্ডকীর জলের রঙ এত কালো। আর ওই শিলাস্তরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা জুরাসিক যুগের অজস্র প্রস্তরীভূত সামুদ্রিক জীবাশ্ম জলের স্রোতে বয়ে আসছে। এই অজস্র শিলাভূত জীবাশ্মর মধ্যে একমাত্র অ্যামনোয়ডিয়া গোষ্ঠীর শিলাভূত জীবাশ্মই হল শালগ্রাম শিলা বা নারায়ণ শিলা।
যুগযুগান্ত ধরে এই কালীগণ্ডকী নদী গণ্ডক পর্বত থেকে শালগ্রাম শিলা বয়ে আনছে আর তারপর বিহারের চম্পারণ জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে পাটনার কাছে শোনপুরে এসে পড়েছে গঙ্গায়। আবার ফিরে আসি জীবাশ্ম প্রসঙ্গে। প্যালিয়োজয়িক কল্পের শুরুতে, মানে আজ থেকে প্রায় ৬০/৬৫ কোটি বছর আগে মলাস্কা পর্বের আদি প্রাণী সেফলোপডের আবির্ভাব। তারপর বিবর্তনের ধারা বেয়ে ২৩/২৫ কোটি বছর আগে এল এই অ্যামোনয়ডিয়া এবং তারই এক জ্ঞাতি ভাই অ্যামোনাইট গোষ্ঠীর এবং জুরাসিক থেকে ক্রিটেশিয়াস, মানে ৮ থেকে ১৫ কোটি বছর আগে এই অ্যামোনাইটের এত আধিক্য ছিল যে এই সময়কালকে বলা হয় অ্যামোনাইট যুগ। এই অ্যামোনাইট বিবর্তিত হয় বহু গণে। যার মধ্যে একটি হোল ‘পেরিসস্ফিংটিস ‘ এই পেরিস্ফিংটিস থেকে প্যারাবলিসোরাঁস, ভিরগাটোস্ফিংটিস আর অলাকোস্ফিংটিস,এই তিন উপগণ আর তাদের থেকে যেসব প্রজাতি জন্ম নিল, প্রধানতঃ তাদের জীবাশ্মকেই নারায়ণ বা শালগ্রাম শিলা রূপে পুজো করা হয়ে থাকে।
এই জীবদেহের সিউচার রেখার অলংকরন সত্যি অসাধারন। প্রাণীদেহের পিঠের দিকে খোলকের ঠিক নিচেই এই কাঁটা বা কঙ্কালের অবস্থান, যা ক্রমশ কুণ্ডলী পাকিয়ে চলে গেছে মস্তিষ্ক অবধি, ঠিক যেমনটি থাকে চিংড়ি মাছের পিঠের দিকে খোলকের নীচের শিরাটা। এটাকে বলা হয় সাইফাঙ্কল টিউব। এর সাহায্যেই বাতাস নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রাণীরা জলের মধ্যে ওঠানামা করত। আদতে নারায়ন শীলা হল এক প্রকার কৃমি জাতীয় প্রাণী। আর আমরা একটা কৃমির জীবাশ্মকে নারায়ণ জ্ঞানে পূজো করি। আর এটা জলে ভেসে থাকার মুল কারণ হল,এটা একটা হালকা ধরনের জীবাশ্ম। চিরতুষারাবৃত হিমালয় থেকে বয়ে আসা গণ্ডকী নদী ছাড়াও, নর্মদা তীরে এবং কচ্ছের কোন কোন জায়গায় শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়।
শালগ্রাম কথাটা বাংলা বা সংস্কৃত শব্দ নয়। সম্ভবত, নেপালের কোন ভাষা থেকে কথাটার উদ্ভব, তারপর কালের প্রভাবে আপন হয়ে গিয়েছে ! দ্বিতীয়ত, এদেশে পাহাড়ের নাম গণ্ডক, নদীর নাম গণ্ডক। এই গণ্ডক কথাটা খুব সম্ভব মধ্যভারতের গোণ্ড উপজাতি থেকেই এসেছে বলে মনে হয়। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী গোণ্ডদের এক শাখা-উপজাতি। গণ্ডক কথাটা সারা নেপালেই বহুল ব্যবহৃত। আর ভূ-বিজ্ঞানে গোণ্ড জাতির নাম থেকেই গণ্ডোয়ানা আন্তর্জাতিক ভাবেই বিখ্যাত।