আজ, ২০২৫ সালের ৩ আগস্ট, জম্মু ও কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার সালিয়া এলাকায় (Kashmir) অবস্থিত করকুট নাগ স্প্রিং-এর পুনরুদ্ধার কাজের সময় একটি অসাধারণ আর্কিওলজিকাল আবিষ্কার ঘটেছে। এই কাজের ফলে শতাব্দীপ্রাচীন হিন্দু দেবমূর্তি এবং ১১টি শিবলিঙ্গ উদ্ধার করা হয়েছে, যা এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গভীরতাকে উন্মোচন করেছে। এই আবিষ্কারটি কেবল আর্কিওলজি প্রেমীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেনি, বরং কাশ্মীর উপত্যকার ধর্মীয় ও সভ্যতার ইতিহাসের পুনর্লেখনের দাবিও জাগিয়ে তুলেছে।
আবিষ্কারের পটভূমি
কাশ্মীরের এই অঞ্চলে স্প্রিং-এর পুনরুদ্ধার কাজ চলাকালীন খননের মাধ্যমে এই প্রাচীন মূর্তি ও শিবলিঙ্গগুলো উদ্ধার হয়। স্থানীয় প্রশাসন ও জম্মু-কাশ্মীর আর্কাইভস, আর্কিওলজি ও মিউজিয়াম বিভাগের কর্তৃপক্ষের তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে যে, এগুলো হিন্দু ধর্মের গভীর সাংস্কৃতিক প্রভাবের প্রমাণ।
উদ্ধারকৃত মূর্তিগুলোতে শিল্পকলার অসাধারণ নমুনা দেখা যাচ্ছে, যা সম্ভবত গান্ধার শৈলীর প্রভাবে গঠিত। গান্ধার শৈলী, যা প্রথম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে কুষাণ সাম্রাজ্যের সময়ে উন্নত হয়েছিল, হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্পকলার সমন্বয়ের জন্য বিখ্যাত। এই মূর্তিগুলোতে সূক্ষ্ম খোদাইকাজ ও ধর্মীয় প্রতীকগুলো এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।
স্থানীয় কাশ্মীরী পণ্ডিতদের মতে, এই অঞ্চলে একসময় করকুটা রাজবংশের প্রভাব ছিল। তাই সম্ভবত এখানে একটি মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল বা এই মূর্তিগুলো সংরক্ষণের জন্য সাবধানে রাখা হয়েছিল। এই আবিষ্কারটি কাশ্মীরের ইতিহাসে নতুন আলোকপাত করতে পারে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী শাসনের ছায়ায় হিন্দু সভ্যতার চিহ্নগুলো কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আর্কিওলজিকাল গবেষণা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
উদ্ধারকৃত মূর্তি ও শিবলিঙ্গগুলোর গুরুত্ব বুঝতে জম্মু-কাশ্মীর আর্কাইভস বিভাগের একটি দল সাইটে গিয়ে পরিদর্শন করেছে। এই দলটি মূর্তিগুলো সংগ্রহ করে শ্রীনগরের এসপিএস মিউজিয়ামে পাঠিয়েছে, যেখানে গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা এদের বয়স ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নির্ণয়ের জন্য পদার্থ বিশ্লেষণ ও কার্বন ডেটিং-এর মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। এই পরীক্ষার ফলাফল কাশ্মীর উপত্যকার প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বুরজাহম আর্কিওলজিকাল সাইটের মতো কাশ্মীরে পূর্বে প্রাপ্ত প্রমাণগুলো নিউলিথিক যুগ (ক্রিস্টপূর্ব ৩০০০-১০০০) থেকে ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন ধারা প্রকাশ করেছে। এই নতুন আবিষ্কারটি সেই ধারার একটি অংশ হতে পারে, যা কাশ্মীরকে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্কিওলজিকাল অঞ্চলগুলোর একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই আবিষ্কারের পর স্থানীয় কাশ্মীরী সম্প্রদায়, বিশেষ করে পণ্ডিত সম্প্রদায়, উচ্চ আবেগে আন্দোলিত হয়েছে। তাদের মতে, এই জায়গাটি একটি প্রাচীন মন্দিরের অংশ ছিল, এবং উদ্ধারকৃত শিবলিঙ্গগুলো পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
তারা সরকারের কাছে দাবি করেছে যে, এই স্থানটি সংরক্ষণ করা হোক এবং একটি নতুন মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করা হোক। এই দাবিটি কাশ্মীরের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
এদিকে, সামাজিক মাধ্যমে এই আবিষ্কার নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়ে গেছে। কিছু ব্যক্তি দাবি করছেন যে, এই মূর্তিগুলো বৌদ্ধ শিল্পকলার প্রভাবে গঠিত হতে পারে, যা গান্ধার সভ্যতার একটি অংশ। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ এখনও এগুলোকে হিন্দু ধর্মের সাথে যুক্ত করছেন, যেহেতু শিবলিঙ্গের উপস্থিতি স্পষ্টভাবে শৈব সম্প্রদায়ের প্রমাণ দেয়।
গোয়ায় প্রকাশ্যে বিয়ারের বোতল খুললেই খসবে ১ লাখ টাকা!
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কাশ্মীরের ইতিহাসে এই আবিষ্কারটি একটি মাইলফলক হতে পারে। কারণ, এটি প্রমাণ করে যে, কাশ্মীর উপত্যকা শুধুমাত্র ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্র নয়, বরং হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। গান্ধার সভ্যতার প্রভাব এখানে স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
সরকারের পক্ষ থেকে এই স্থানটিকে একটি আর্কিওলজিকাল স্থান হিসেবে ঘোষণা করা এবং গবেষণার জন্য যথেষ্ট তহবিল বরাদ্দ করা জরুরি। এই আবিষ্কারটি কাশ্মীরের পর্যটন ক্ষেত্রেও একটি নতুন দিশা আনতে পারে, যেখানে ইতিহাস ও সংস্কৃতির ভাল্লভ হয়ে উঠবে।
সুতরাং, কাশ্মীরের মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এই শতাব্দীপ্রাচীন সম্পদ উদ্ধারের মাধ্যমে আমরা একটি বড় ঐতিহাসিক সত্যের সামনে দাঁড়িয়েছি। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতীক নয়, বরং মানব সভ্যতার একটি অমূল্য ঐতিহ্য, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।