গণেশ চতুর্থী! ভগবান গণেশের জন্মদিন (Ganesh Chaturthi) উদযাপনের একটি প্রধান হিন্দু উৎসব, ভারত এবং বিশ্বজুড়ে ভক্তদের মধ্যে অপার উৎসাহ নিয়ে আসে। বিঘ্নহর্তা এবং জ্ঞান, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবতা হিসেবে পরিচিত গণেশের এই উৎসব ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে শুরু হয় এবং দশ দিন ধরে চলে, যা অষ্টম চতুর্দশীতে গণেশ বিসর্জনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। ২০২৫ সালে গণেশ চতুর্থী ২৭ আগস্ট, বুধবার পালিত হবে। এই প্রতিবেদনে আমরা গণেশ চতুর্থী ২০২৫-এর শ্রেষ্ঠ পূজার সময়, আচার-অনুষ্ঠান এবং এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
গণেশ চতুর্থী ২০২৫: তারিখ ও শুভ মুহূর্ত
হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, ভাদ্রপদ মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথি ২৬ আগস্ট ২০২৫-এ দুপুর ১:৫৪ মিনিটে শুরু হবে এবং ২৭ আগস্ট ২০২৫-এ বিকেল ৩:৪৪ মিনিটে শেষ হবে। উদয়া তিথি অনুসারে, গণেশ চতুর্থী ২৭ আগস্ট পালিত হবে। শ্রেষ্ঠ পূজার সময় বা মধ্যাহ্ন গণেশ পূজা মুহূর্ত হল ১১:০৫ সকাল থেকে ১:৪০ অপরাহ্ন পর্যন্ত (২ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট)। এই সময়টি গণেশ স্থাপনা এবং পূজার জন্য সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়, কারণ বিশ্বাস করা হয় যে গণেশের জন্ম মধ্যাহ্নে হয়েছিল।
শহরভিত্তিক শুভ মুহূর্ত (২৭ আগস্ট ২০২৫):
নতুন দিল্লি: ১১:০৫ সকাল – ১:৪০ অপরাহ্ন
মুম্বই: ১১:২৪ সকাল – ১:৫৫ অপরাহ্ন
কলকাতা: ১০:২২ সকাল – ১২:৫৪ অপরাহ্ন
পুণে: ১১:২১ সকাল – ১:৫১ অপরাহ্ন
আহমেদাবাদ: ১১:২৫ সকাল – ১:৫৭ অপরাহ্ন
নয়ডা: ১১:০৫ সকাল – ১:৩৯ অপরাহ্ন
গুড়গাঁও: ১১:০৬ সকাল – ১:৪০ অপরাহ্ন
জয়পুর: ১১:১১ সকাল – ১:৪৫ অপরাহ্ন
অন্যান্য শুভ মুহূর্ত:
ব্রহ্ম মুহূর্ত: ৩:৫৮ সকাল – ৪:৪৩ সকাল
বিজয় মুহূর্ত: ১:৫৮ অপরাহ্ন – ২:৪৯ অপরাহ্ন
এই সময়ে গণেশ স্থাপনা এবং পূজা করলে ভক্তরা সমৃদ্ধি, জ্ঞান এবং বাধা দূরীকরণের আশীর্বাদ পান।
চন্দ্র দর্শন নিষিদ্ধ সময়:
হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, গণেশ চতুর্থীতে চাঁদ দেখা মিথ্যা দোষ (মিথ্যা অপবাদ) সৃষ্টি করতে পারে। ২০২৫ সালে চন্দ্র দর্শন এড়ানোর সময়:
২৬ আগস্ট: দুপুর ১:৫৪ থেকে রাত ৮:২৯ পর্যন্ত (৬ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট)
২৭ আগস্ট: সকাল ৯:২৮ থেকে রাত ৮:৫৭ পর্যন্ত (১১ ঘণ্টা ২৯ মিনিট)
যদি ভুলবশত চাঁদ দেখা হয়, তবে নিম্নলিখিত মন্ত্র পাঠ করা উচিত:
“সিংহঃ প্রসেনমবধীৎ সিংহো জাম্ববতা হতঃ। সুকুমারক মারোদীস্তব হ্যেষ স্যমন্তকঃ॥”
গণেশ পূজার আচার-অনুষ্ঠান
গণেশ চতুর্থী পূজা একটি বিশেষ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যা ভক্তিভরে পালন করা হয়। নিম্নলিখিত ধাপগুলি পূজার জন্য প্রয়োজনীয়:
প্রস্তুতি ও গণেশ স্থাপনা:
বাড়ি এবং পূজার স্থান পরিষ্কার করুন। পরিবেশবান্ধব মাটির মূর্তি ব্যবহার করুন।
একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে গণেশের মূর্তি স্থাপন করুন এবং ফুল, তোরণ এবং আলো দিয়ে সাজান।
প্রাণপ্রতিষ্ঠা: পুরোহিত বা ভক্ত মন্ত্র উচ্চারণ করে মূর্তিতে গণেশের আহ্বান করেন।
পূজার উপকরণ:
মোদক, দূর্বা ঘাস, লাল ফুল, নারকেল, গুড়, চন্দন, কুমকুম, ধূপ, দীপ এবং পঞ্চামৃত (দুধ, দই, ঘি, মধু, চিনি)।
আন্ধ্রপ্রদেশে, কুদুমু (মোদকের স্থানীয় রূপ), পানকম (ইলাচি-যুক্ত পানীয়), এবং চালিবিদি (মিষ্টি চালের প্রস্তুতি) ব্যবহৃত হয়।
পূজা বিধি:
মধ্যাহ্ন মুহূর্তে পূজা শুরু করুন। গণেশের মূর্তিকে চন্দন, কুমকুম এবং ফুল দিয়ে স্নান করান।
বৈদিক মন্ত্র যেমন “ওঁ গং গণপতয়ে নমঃ” জপ করুন।
মোদক, দূর্বা এবং অন্যান্য নৈবেদ্য উৎসর্গ করুন।
আরতি করুন এবং প্রসাদ বিতরণ করুন।
বিসর্জন:
উৎসব ১.৫, ৩, ৫, ৭ বা ১০ দিন ধরে পালিত হয়, যা ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ অষ্টম চতুর্দশীতে বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়।
মূর্তি নদী, হ্রদ বা সমুদ্রে বিসর্জন করা হয়, সঙ্গে সঙ্গীত, নৃত্য এবং “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া” ধ্বনি। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম ট্যাঙ্ক বা বাড়িতে বিসর্জনের প্রচলন বাড়ছে।
গণেশ চতুর্থীর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
গণেশ চতুর্থী শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং নতুন শুরুর প্রতীক। ভগবান গণেশকে বিঘ্নহর্তা (বাধা দূরকারী) এবং মঙ্গলকর্তা (সমৃদ্ধির দাতা) হিসেবে পূজা করা হয়। এই উৎসব ভক্তদের জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি এবং সাফল্য নিয়ে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং গোয়ায় এই উৎসব বিশেষ উৎসাহে পালিত হয়। মুম্বইয়ের লালবাগচা রাজা এবং পুণের পাবলিক উৎসব এই উৎসবের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।
২০২৫ সালে, গণেশ চতুর্থীতে প্রীতি, সর্বার্থ সিদ্ধি, রবি, এবং ইন্দ্র-ব্রহ্ম যোগের মতো শুভ যোগ গঠিত হবে, যা পূজার ফলাফলকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এছাড়া, কর্কট রাশিতে বুধ এবং শুক্রের উপস্থিতি লক্ষ্মী নারায়ণ যোগ তৈরি করবে, যা ভক্তদের জন্য আর্থিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে।
পরিবেশবান্ধব উদযাপন
আধুনিক সময়ে, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য পরিবেশবান্ধব গণেশ মূর্তি (মাটি বা জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি) এবং প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার বাড়ছে। ভক্তরা প্লাস্টিক বা থার্মোকলের সজ্জা এড়িয়ে চলছেন এবং বিসর্জনের জন্য কৃত্রিম জলাশয় বা বাড়িতে ছোট পাত্র ব্যবহার করছেন। এটি জল দূষণ কমায় এবং উৎসবের পবিত্রতা বজায় রাখে।
পশ্চিমবঙ্গে গণেশ চতুর্থী
পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায়, গণেশ চতুর্থী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় উৎসাহে পালিত হয়। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল স্থাপন করা হয়, এবং সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে পূজা, ভজন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কলকাতার শুভ মুহূর্ত (১০:২২ সকাল – ১২:৫৪ অপরাহ্ন) অনুসরণ করে ভক্তরা গণেশের পূজা করেন। এছাড়া, পরিবেশবান্ধব উদযাপনের প্রতি সচেতনতা বাড়ছে, এবং অনেক সম্প্রদায় মাটির মূর্তি এবং টেকসই সজ্জা ব্যবহার করছে।
গণেশ চতুর্থী ২০২৫ ভক্তদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব, যা জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং নতুন শুরুর প্রতীক। শুভ মুহূর্তে পূজা, পরিবেশবান্ধব মূর্তি এবং ভক্তিপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব ভক্তদের জীবনে আনন্দ এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া” ধ্বনির মাধ্যমে ভক্তরা গণেশের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন এবং পরের বছর তার পুনরাগমনের জন্য অপেক্ষা করেন।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
