ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ! হিন্দু সৃষ্টি মিথ ও ত্রিমূর্তির ভূমিকার সহজ ব্যাখ্যা

হিন্দু ধর্মের (Hindu mythology) ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ (শিব)—হিন্দু পুরাণের মূল ভিত্তি। এই তিন দেবতা সৃষ্টি, পালন এবং ধ্বংসের প্রতিনিধিত্ব করেন, যা হিন্দু সৃষ্টি মিথের…

Brahma, Vishnu, Mahesh: Understanding Their Roles in Hindu Creation Myth and Trimurti Meaning

হিন্দু ধর্মের (Hindu mythology) ত্রিমূর্তি—ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ (শিব)—হিন্দু পুরাণের মূল ভিত্তি। এই তিন দেবতা সৃষ্টি, পালন এবং ধ্বংসের প্রতিনিধিত্ব করেন, যা হিন্দু সৃষ্টি মিথের কেন্দ্রীয় ধারণা। ত্রিমূর্তির ধারণা হিন্দু দর্শনে বিশ্বের চক্রাকার প্রকৃতি এবং জীবনের ভারসাম্যের প্রতীক। এই প্রতিবেদনে আমরা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশের ভূমিকা, ত্রিমূর্তির অর্থ এবং হিন্দু সৃষ্টি মিথের সহজ ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করব।

ত্রিমূর্তির ধারণা ও অর্থ
হিন্দু ধর্মে ত্রিমূর্তি শব্দটির অর্থ হলো তিনটি মূর্তি বা তিনটি দেবতার সমষ্টি—ব্রহ্মা (স্রষ্টা), বিষ্ণু (পালনকর্তা) এবং মহেশ বা শিব (ধ্বংসকর্তা)। এই তিন দেবতা বিশ্বের সৃষ্টি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেন। হিন্দু দর্শন অনুসারে, এই তিনটি প্রক্রিয়া জীবনের চক্রাকার প্রকৃতির অংশ, যেখানে সৃষ্টির পর পালন এবং শেষে ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয়। ত্রিমূর্তির এই ধারণা হিন্দু পুরাণের গ্রন্থ, যেমন বেদ, পুরাণ এবং মহাভারত, থেকে উদ্ভূত।

   

ব্রহ্মা: সৃষ্টির দেবতা
ব্রহ্মা হলেন হিন্দু পুরাণের স্রষ্টা দেবতা। তিনি বিশ্ব, জীবজগৎ এবং সমস্ত প্রাণীর সৃষ্টি করেন। হিন্দু সৃষ্টি মিথ অনুসারে, বিষ্ণুর নাভি থেকে একটি পদ্মফুলের মধ্যে ব্রহ্মার জন্ম হয়। তিনি চার মুখবিশিষ্ট, যা চার বেদ—ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদের প্রতীক। ব্রহ্মার স্ত্রী সরস্বতী, জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী, তাঁকে সৃজনশীলতায় সহায়তা করেন।

ব্রহ্মার প্রধান কাজ হলো বিশ্বের সৃষ্টি। পুরাণে বর্ণিত আছে যে ব্রহ্মা প্রথমে মানুষ, দেবতা, অসুর এবং প্রকৃতির সৃষ্টি করেন। তবে, হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মার পূজা তুলনামূলকভাবে কম হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ব্রহ্মার সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে, এবং এখন বিষ্ণু ও শিবের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে পুষ্করের ব্রহ্মা মন্দির এবং কিছু নির্দিষ্ট স্থানে তাঁর পূজা হয়।

বিষ্ণু: পালনকর্তা দেবতা
বিষ্ণু হলেন বিশ্বের রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি বিশ্বের ভারসাম্য বজায় রাখেন এবং মন্দের বিরুদ্ধে সত্য ও ধর্ম রক্ষা করেন। বিষ্ণুর দশ অবতার, যা দশাবতার নামে পরিচিত, হিন্দু পুরাণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অবতারগুলির মধ্যে রয়েছে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ এবং কল্কি। প্রতিটি অবতার পৃথিবীতে ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নেমে আসে।

বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবী। তিনি শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করেন, যা তাঁর শক্তি ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। বিষ্ণুর পূজা হিন্দু সম্প্রদায়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়, এবং তিরুপতি বালাজি, বদ্রীনাথ এবং জগন্নাথ মন্দির তাঁর প্রধান তীর্থস্থান। বিষ্ণুকে হিন্দু ধর্মে সকলের রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মহেশ (শিব): ধ্বংসের দেবতা
মহেশ বা শিব হলেন ধ্বংসের দেবতা, তবে তাঁর ধ্বংস সৃষ্টির জন্য পথ প্রশস্ত করে। শিবের ধ্বংসের ভূমিকা শুধুমাত্র ধ্বংসাত্মক নয়, বরং এটি পুনর্জনন ও পুনঃসৃষ্টির প্রতীক। শিব ত্রিশূল, ডমরু এবং সাপ ধারণ করেন এবং তাঁর কপালে তৃতীয় নয়ন রয়েছে, যা জ্ঞান ও শক্তির প্রতীক।

Advertisements

শিবের স্ত্রী পার্বতী, এবং তাঁর পুত্র গণেশ ও কার্তিকেয়। শিবের পূজা হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত জনপ্রিয়, এবং কাশী বিশ্বনাথ, সোমনাথ এবং অমরনাথ তাঁর প্রধান তীর্থস্থান। মহাশিবরাত্রি উৎসব শিবের প্রতি ভক্তি প্রকাশের অন্যতম উপলক্ষ। শিবকে আদি যোগী এবং মহাদেব হিসেবেও পূজা করা হয়।

হিন্দু সৃষ্টি মিথ
হিন্দু সৃষ্টি মিথ অনুসারে, বিশ্বের সূচনা হয়েছিল শূন্যতা থেকে। বিষ্ণু শেষ নাগের উপর শুয়ে ছিলেন, এবং তাঁর নাভি থেকে পদ্মফুলে ব্রহ্মার জন্ম হয়। ব্রহ্মা বিশ্ব, সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, এবং জীবজগৎ সৃষ্টি করেন। বিষ্ণু এই সৃষ্টির রক্ষণাবেক্ষণ করেন, এবং শিব প্রয়োজন অনুসারে ধ্বংসের মাধ্যমে নতুন সৃষ্টির পথ তৈরি করেন। এই চক্রাকার প্রক্রিয়া হিন্দু দর্শনে কালের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে যুগ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশ্ব পুনর্জনন লাভ করে।

পুরাণে আরও বর্ণিত আছে যে ব্রহ্মার এক দিন (কল্প) ৪.৩২ বিলিয়ন বছরের সমান, এবং এই সময়ের শেষে শিব বিশ্বকে ধ্বংস করেন, যা পরবর্তী সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়। এই ধারণা হিন্দু ধর্মের চক্রাকার সময়ের দর্শনকে প্রকাশ করে।

ত্রিমূর্তির তাৎপর্য
ত্রিমূর্তির ধারণা হিন্দু ধর্মে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের প্রতীক। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব পরস্পরের পরিপূরক। সৃষ্টি ছাড়া পালন সম্ভব নয়, এবং ধ্বংস ছাড়া নতুন সৃষ্টির পথ প্রশস্ত হয় না। এই তিন দেবতা একসঙ্গে বিশ্বের চক্রাকার প্রকৃতি এবং জীবনের গতিশীলতার প্রতিনিধিত্ব করেন।
হিন্দু ধর্মে ত্রিমূর্তির পূজা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভিন্নভাবে হয়। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুকে সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে পূজা করেন, শৈবরা শিবকে, এবং কিছু সম্প্রদায় ব্রহ্মাকে সম্মান জানায়। তবে, ত্রিমূর্তির ধারণা হিন্দু ধর্মের ঐক্য ও বৈচিত্র্যের প্রতীক।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে ত্রিমূর্তি
আধুনিক যুগে ত্রিমূর্তির ধারণা হিন্দু ধর্মের দর্শন এবং সংস্কৃতির অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষকে জীবনের চক্রাকার প্রকৃতি এবং পরিবর্তনের গ্রহণযোগ্যতা শেখায়। ত্রিমূর্তির গল্পগুলি ভারতের শিল্প, সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রে প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, মহাভারত এবং রামায়ণে বিষ্ণুর অবতারগুলির গল্প ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ হিন্দু সৃষ্টি মিথের মূল স্তম্ভ। ত্রিমূর্তির ধারণা হিন্দু ধর্মের দর্শন এবং জীবনের চক্রাকার প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। ব্রহ্মার সৃষ্টি, বিষ্ণুর পালন এবং শিবের ধ্বংস বিশ্বের ভারসাম্য বজায় রাখে। এই তিন দেবতার গল্প হিন্দু ধর্মের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং দার্শনিক গভীরতার প্রতীক। ত্রিমূর্তির এই সহজ ব্যাখ্যা হিন্দু পুরাণের জটিল ধারণাগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়।