প্রাচীন বাংলা গ্রন্থে উল্লিখিত ৫টি পৌরাণিক প্রাণী, ভারতীয় মিথের রহস্যময় জগৎ

Bengali Mythology Creatures: বাংলার সাংস্কৃতিক ও পৌরাণিক ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ, লোককথা এবং পুরাণে উল্লিখিত পৌরাণিক প্রাণীগুলি এই অঞ্চলের সৃজনশীল কল্পনা এবং আধ্যাত্মিক…

5 Mythical Creatures from Ancient Bengali Texts

Bengali Mythology Creatures: বাংলার সাংস্কৃতিক ও পৌরাণিক ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ, লোককথা এবং পুরাণে উল্লিখিত পৌরাণিক প্রাণীগুলি এই অঞ্চলের সৃজনশীল কল্পনা এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের প্রতীক। এই প্রাণীগুলি কেবল গল্পের অংশ নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির নৈতিকতা, ভয়, এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতিফলন। থাকুরমার ঝুলি, চণ্ডীমঙ্গল, এবং মনসামঙ্গলের মতো গ্রন্থে এই পৌরাণিক প্রাণীগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনে আমরা প্রাচীন বাংলা গ্রন্থে উল্লিখিত পাঁচটি পৌরাণিক প্রাণী—ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, পেঞ্চাপেঞ্চি, নাগ, শঙ্খচূড়, এবং বেঘো ভূত—নিয়ে আলোচনা করব।

১. ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী: জ্ঞানী পাখি
ব্যাঙ্গমা (পুরুষ) এবং ব্যাঙ্গমী (স্ত্রী) বাংলা লোককথায় জ্ঞানী এবং ভবিষ্যদ্বক্তা পাখি হিসেবে পরিচিত। থাকুরমার ঝুলির গল্পগুলিতে এই পাখিদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তারা যোগ্য ব্যক্তিদের সাহায্য করে। এই পৌরাণিক পাখিরা অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের অধিকারী এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে। এদের চেহারা সাধারণত স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয় না, তবে এদের কথাবার্তা এবং বুদ্ধিমত্তা গল্পের নায়ক-নায়িকাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী বাঙালি শিশুদের কাছে জনপ্রিয়, কারণ এদের গল্পগুলি নৈতিক শিক্ষা এবং বুদ্ধির গুরুত্ব তুলে ধরে। এই প্রাণীগুলি বাংলা লোককথায় জ্ঞান ও বিবেকের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।

   

২. পেঞ্চাপেঞ্চি: রক্তপায়ী পেঁচা
পেঞ্চাপেঞ্চি বাংলার ভয়ঙ্কর পৌরাণিক প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এই প্রাণীটি দেখতে পেঁচার মতো হলেও এর আচরণ অত্যন্ত ভয়ানক। বাংলার লোককথায় বলা হয়, পেঞ্চাপেঞ্চি বনের একাকী পথিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের রক্ত শুষে নেয়। এটি ভ্যাম্পায়ারের মতো কল্পনা করা হয়, তবে এর শিকার কেবল রক্তপানের পর মৃত্যুবরণ করে, এটি পেঞ্চাপেঞ্চিতে রূপান্তরিত হয় কিনা তা স্পষ্ট নয়। এই প্রাণীটি বাঙালি সমাজে ভয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, এবং এটি শিশুদের বনে একা না যাওয়ার জন্য সতর্ক করতে ব্যবহৃত হতো। পেঞ্চাপেঞ্চির গল্প বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত, এবং এটি অন্ধকার ও অজানা ভয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

৩. নাগ: সর্পদেবতা
নাগ বা সাপ হিন্দু এবং বাংলা পৌরাণিক কাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। বাংলার মনসামঙ্গল কাব্যে নাগদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, যেখানে এরা মনসা দেবীর সঙ্গে যুক্ত। নাগরাজ তক্ষক, উলূপী, এবং বাসুকি হলেন বিখ্যাত নাগ চরিত্র। তক্ষক মহাভারতে অর্জুনের সঙ্গে যুক্ত, এবং বাসুকি শিবের গলায় সর্পরূপে থাকেন। নাগরা জল, উর্বরতা, এবং ভূগর্ভের সম্পদের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত। এদের কখনও কখনও বিষাক্ত এবং ভয়ঙ্কর, আবার কখনও রক্ষাকর্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মনসা দেবীর পূজায় নাগদের উপস্থিতি বাংলার গ্রামীণ সমাজে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। নাগদের গল্প বাংলার পৌরাণিক ঐতিহ্যে প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।

৪. শঙ্খচূড়: বিবাহিত নারীর ভূত
শঙ্খচূড় বা শঙ্খচূড়নী বাংলা লোককথায় বিবাহিত নারীর ভূত হিসেবে পরিচিত। এরা সাধারণত শাঁখা-পলা পরা, যা বাঙালি হিন্দু বিবাহিত নারীদের প্রতীক। শঙ্খচূড়নী প্রায়শই গাছের উপর বাস করে এবং যারা তাদের বিরক্ত করে তাদের উপর আক্রমণ করে। এই ভূত অপূর্ণ ইচ্ছা বা অকাল মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট বলে মনে করা হয়। বাংলার লোককথায় শঙ্খচূড়নীকে শামানিক আচারের মাধ্যমে তাড়ানো যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এই প্রাণীটি বাঙালি সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থান এবং অপূর্ণতার ভয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। শঙ্খচূড়নীর গল্প বাংলার গ্রামীণ জীবনে ভয় ও সম্মানের মিশ্রণ তৈরি করে।

Advertisements

৫. বেঘো ভূত: সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর আত্মা
বেঘো ভূত সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত একটি পৌরাণিক প্রাণী। এরা বাঘের দ্বারা নিহত বা খাদ্য হওয়া মানুষের অসন্তুষ্ট আত্মা বলে বিশ্বাস করা হয়। স্থানীয় লোককথা অনুসারে, বেঘো ভূত মধু বা কাঠ সংগ্রহের জন্য বনে প্রবেশকারীদের ভয় দেখায় এবং তাদের বাঘের দিকে ঠেলে দেয়। কখনও কখনও এরা বাঘের রূপ ধরে মানুষকে ভয় পাওয়ায়। সুন্দরবনের জেলে এবং মৌলিরা এই ভূতের ভয়ে বিশেষ মন্ত্র ও পূজা করে। বেঘো ভূত বাংলার পৌরাণিক ঐতিহ্যে প্রকৃতির শক্তি এবং মানুষের ভয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

পৌরাণিক প্রাণীদের তাৎপর্য
এই পৌরাণিক প্রাণীগুলি বাংলার সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী জ্ঞান ও বিবেকের প্রতীক, পেঞ্চাপেঞ্চি অজানা ভয়ের, নাগ প্রকৃতি ও আধ্যাত্মিকতার, শঙ্খচূড়নী সামাজিক নিয়মের, এবং বেঘো ভূত প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এই গল্পগুলি বাঙালি সমাজে নৈতিক শিক্ষা, সতর্কতা, এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস প্রচার করে। চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, এবং থাকুরমার ঝুলির মতো গ্রন্থ এই প্রাণীদের গল্পের মাধ্যমে বাংলার সমৃদ্ধ পৌরাণিক ঐতিহ্য তুলে ধরে।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব
আধুনিক যুগে এই পৌরাণিক প্রাণীগুলির গল্প বাংলা সাহিত্য, চলচ্চিত্র, এবং শিল্পে প্রভাব ফেলেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক তাঁদের গল্পে এই প্রাণীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ গল্পে ভূত ও অতিপ্রাকৃত প্রাণীদের উল্লেখ রয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে ‘কঙ্কাল’ (১৯৫০) এবং ‘মণিহারা’ (১৯৬১) এর মতো কাজে এই পৌরাণিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও, ওটিবেগুনির মতো প্রকল্প বাংলার পৌরাণিক প্রাণীদের উপর গবেষণা করে এবং এদের নিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করছে, যা বাংলার ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে।

প্রাচীন বাংলা গ্রন্থে উল্লিখিত পৌরাণিক প্রাণীগুলি বাংলার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী, পেঞ্চাপেঞ্চি, নাগ, শঙ্খচূড়, এবং বেঘো ভূতের গল্প বাঙালি জীবনের ভয়, বিশ্বাস, এবং নৈতিকতার প্রতিফলন। এই প্রাণীগুলি শুধুমাত্র গল্পের অংশ নয়, বরং বাংলার সমাজ, প্রকৃতি, এবং ধর্মের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করে। এই পৌরাণিক গাথাগুলি বাংলার ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে এবং আধুনিক যুগে এদের পুনঃআবিষ্কার ভারতীয় পৌরাণিক জগৎকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।