নেপাল সরকার মাউন্ট এভারেস্ট (Mount Everest ) আরোহণে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিকল্পনা করেছে। নতুন প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র যেসব পর্বতারোহী অন্তত একটি ৭,০০০ মিটারের উচ্চতার চূড়ায় আরোহণ করেছেন, তারাই এভারেস্টে আরোহণের অনুমতি পাবেন। এই নিয়মের লক্ষ্য উচ্চ-উচ্চতার ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মৃত্যুর সংখ্যা কমানো এবং পর্বতের পরিবেশ রক্ষা করা। কাঠমান্ডু পোস্টের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বছরের বসন্তে ইতিমধ্যে ৪০২ জন পর্বতারোহী এভারেস্ট আরোহণের অনুমতি পেয়েছেন, এবং এই সংখ্যা শীঘ্রই ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এভারেস্টের ঐতিহাসিক ও বর্তমান চিত্র
১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি এবং নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগে প্রথমবারের মতো ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার (২৯,০৩২ ফুট) উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন। নেপালে ‘সাগরমাথা’ নামে পরিচিত এই পর্বত বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে পর্বতারোহীদের কাছে একটি স্বপ্নের গন্তব্য। আনুষ্ঠানিক তথ্য অনুসারে, ১৯৫৩ সাল থেকে প্রায় ৯,০০০ পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেছেন, তবে ৩০০-এর বেশি আরোহী এই প্রয়াসে প্রাণ হারিয়েছেন।
এভারেস্টের জনপ্রিয়তা নেপালের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। কাঠমান্ডু পোস্টের একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বসন্তকালে ৪০০-৫০০ পর্বতারোহী এবং তাদের গাইডসহ মোট ১,০০০-এর বেশি মানুষ এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করেন। এই ভিড়ের ফলে ‘ডেথ জোন’-এ (৮,০০০ মিটারের উপরে অক্সিজেনের অভাবে বেঁচে থাকা কঠিন অঞ্চল) ট্রাফিক জ্যাম, পর্বতারোহীদের মৃত্যু (২০২৩ সালে ১৭ এবং ২০২৪ সালে ৮ জন), দ্রুত হিমবাহ গলন এবং এভারেস্টের ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ আবর্জনার স্তূপ’ হিসেবে কুখ্যাতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইন্টিগ্রেটেড টুরিজম বিল: নতুন নিয়মাবলী
১৮ এপ্রিল, ২০২৫-এ নেপালের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে নথিভুক্ত ইন্টিগ্রেটেড টুরিজম বিল এভারেস্ট আরোহণে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এই বিল অনুসারে, এভারেস্টে আরোহণের জন্য আবেদনকারীদের অবশ্যই নেপালের অন্তত একটি ৭,০০০ মিটারের উচ্চতার পর্বত (যেমন আনাপূর্ণা, ধৌলাগিরি বা মানাসলু) জয়ের প্রমাণপত্র জমা দিতে হবে। এই শর্তের উদ্দেশ্য অপ্রস্তুত বা অনভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের কারণে ঝুঁকি কমানো। তবে, আন্তর্জাতিক অভিযান সংগঠকরা এই নিয়মের সমালোচনা করেছেন, কারণ এটি শুধুমাত্র নেপালের ৭,০০০ মিটারের পর্বতের অভিজ্ঞতাকেই বিবেচনা করে, অন্য দেশের পর্বত যেমন আকনকাগুয়া বা ডেনালির অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে না।
বিলটিতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম রয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষা এখন বাধ্যতামূলক; পর্বতারোহীদের সরকার-অনুমোদিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে গত এক মাসের মধ্যে জারি করা স্বাস্থ্য শংসাপত্র জমা দিতে হবে। স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকলে আরোহণে অংশ নেওয়া যাবে না। এছাড়া, প্রতি দুই পর্বতারোহীর জন্য একজন নেপালি গাইড নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই নিয়ম নিয়েও বিতর্ক রয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক অভিযান সংগঠকরা মনে করেন, নেপালে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইএফএমজিএ (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ মাউন্টেন গাইডস অ্যাসোসিয়েশন) সার্টিফায়েড গাইড নেই।
মৃতদেহ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সুরক্ষা
এভারেস্টে মৃতদেহ উদ্ধার একটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া, যার খরচ ২০,০০০ থেকে ২০০,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। নতুন বিলে মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত বীমা কভারেজের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, যদি কোনো পর্বতারোহী এক বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ থাকেন এবং না পাওয়া যায়, তবে তাকে আইনত মৃত ঘোষণা করা হবে।
পরিবেশ সুরক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৪,০০০ ডলারের ফেরতযোগ্য আবর্জনা জামানতের পরিবর্তে একটি ফেরতঅযোগ্য আবর্জনা ফি চালু করা হবে। এছাড়া, খুম্বু পাসাং লামু গ্রামীণ পৌরসভা পর্বতারোহীদের জন্য বায়োডিগ্রেডেবল ‘পু ব্যাগ’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। ২০২৪ সালের বসন্তে সাগরমাথা পলিউশন কন্ট্রোল কমিটি (এসপিসিসি) ৮৫ টন আবর্জনা সংগ্রহ করেছে, যা পরিবেশগত সমস্যার গুরুত্ব তুলে ধরে।
নতুন নিয়মের সমালোচনা
নতুন নিয়মগুলো নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রশংসিত হলেও, কিছু বিশেষজ্ঞ এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নেপাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট অং শেরিং শেরপা বলেন, “৭,০০০ মিটার এবং ৮,০০০ মিটারের পর্বত আরোহণের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী? মৃত্যু কোনো পার্থক্য করে না।” তিনি মনে করেন, এই নিয়ম গুরুতর পর্বতারোহীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে। এছাড়া, ১৯৯৫-৯৬ সালে ৬,০০০ মিটারের পর্বত আরোহণের শর্ত চালু করা হয়েছিল, কিন্তু অভিযানের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তা প্রত্যাহার করা হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
নেপালের অর্থনীতি পর্বতারোহণ, ট্রেকিং এবং পর্যটনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভারেস্টের অনুমতি ফি ১১,০০০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৫,০০০ ডলার করা হয়েছে, যা ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। এই বছরের বসন্তে এভারেস্ট থেকে ৫০৮ মিলিয়ন টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। তবে, নতুন নিয়ম এবং ফি বৃদ্ধি পর্যটন আয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ইন্টিগ্রেটেড টুরিজম বিল এখনও খসড়া আকারে রয়েছে এবং পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে আলোচনার পর চূড়ান্ত হবে। তবে, এই বিল নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং শৃঙ্খলা আনার জন্য নেপাল সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে। অভিজ্ঞ পর্বতারোহীদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং কঠোর নিয়ম চালুর মাধ্যমে নেপাল এভারেস্টকে আরও নিরাপদ এবং টেকসই গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতে চায়।


