এবার খারাপ স্মৃতি হয়ে যাবে ‘ডিলিট’!

আমাদের জীবনে খারাপ স্মৃতির (Bad Memories) প্রভাব অনেক গভীর। এক একটি খারাপ স্মৃতি মনে পড়লে অনেক সময় জীবনের গতি থেমে যেতে পারে, বিশেষ করে মানসিকভাবে…

Scientists Discover Breakthrough Method to Erase Bad Memories

আমাদের জীবনে খারাপ স্মৃতির (Bad Memories) প্রভাব অনেক গভীর। এক একটি খারাপ স্মৃতি মনে পড়লে অনেক সময় জীবনের গতি থেমে যেতে পারে, বিশেষ করে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে। অনেক মানুষ এই স্মৃতিগুলো নিয়ে বছরের পর বছর সমস্যায় ভোগে। কিছু স্মৃতি এমন হয়, যা না চাইতেও মনে ফিরে আসে এবং সেগুলো জীবনকে বিষিয়ে তোলে। তবে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ফলে খারাপ স্মৃতিগুলোকে স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

একদল বিজ্ঞানী সম্প্রতি এমন একটি নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যার মাধ্যমে মানুষের খারাপ স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা সম্ভব হতে পারে। এই আবিষ্কারটি ইতিমধ্যেই অনেকের কাছে আশার আলো হিসেবে দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা খারাপ স্মৃতির মোকাবিলার উপায় নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তারা শেষ পর্যন্ত একটি কার্যকরী উপায় বের করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে এর নৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে।

স্মৃতি কি, এবং কীভাবে এটি আমাদের প্রভাবিত করে?
আমাদের মস্তিষ্কে স্মৃতিগুলো সংরক্ষিত হয় নিউরনের মাধ্যমে। নিউরন হচ্ছে মস্তিষ্কের মূল কার্যকারী সেল, যা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আমাদের অনুভূতি, চিন্তা এবং স্মৃতি তৈরি করে। এই নিউরনের সংযোগগুলি স্মৃতির আবেগীয় গুরুত্ব ও পুনরাবৃত্তির ওপর ভিত্তি করে শক্তিশালী বা দুর্বল হয়ে ওঠে। একে বলা হয় নিউরাল প্লাস্টিসিটি।

খারাপ স্মৃতির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে একটি শক্তিশালী আবেগীয় চিহ্ন তৈরি হয়, যা মানুষের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। এই স্মৃতিগুলো হয়তো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মনকে দখল করে রাখে, যার ফলে উদ্বেগ, দুঃখ, হতাশা বা ভয় অনুভূত হতে পারে। জীবনের এসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতা মানুষকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে।

এখন, গবেষকরা যে পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, তা মূলত স্মৃতির নব্য সংস্থান বা রিকনসলিডেশন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। রিকনসলিডেশন হল একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কে একবার সংরক্ষিত স্মৃতিগুলো যখন পুনরায় স্মরণ করা হয়, তখন সেগুলি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই অস্থির মুহূর্তে স্মৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছেন, যাতে স্মৃতির আবেগীয় প্রভাব কমানো যায় এবং সেই স্মৃতি কম শক্তিশালী হয়।

স্মৃতি মুছে ফেলার নতুন পদ্ধতি
গবেষকরা দেখেছেন যে, যখন আমরা পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করি, তখন সেগুলো অস্থির হয়ে পড়ে। এই সময়ে মস্তিষ্কে সেগুলোর শক্তি বা সংযোগ দুর্বল করা সম্ভব হতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি রিকনসলিডেশন নামে পরিচিত। আর এ সময়েই খারাপ স্মৃতির প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করা যেতে পারে।

এবার আসুন জানি যে, কীভাবে খারাপ স্মৃতি মুছে ফেলার উপায় কাজ করে।
১. ওষুধের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ
গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খারাপ স্মৃতির আবেগীয় প্রভাব কমাতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রোপ্রানলল (Propranolol) নামক একটি ওষুধ রয়েছে, যা সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। এই ওষুধটি স্ট্রেস-সম্পর্কিত হরমোনগুলোকে বাধা দিয়ে স্মৃতির আবেগীয় অংশ দুর্বল করতে সাহায্য করে। প্রোপ্রানলল খাওয়ার পর খারাপ স্মৃতি মনে পড়লেও এর সঙ্গে যুক্ত আবেগগুলো কম অনুভূত হয়। ফলে, মানুষের মন থেকে সেই স্মৃতির ভয় বা দুঃখ কমে যেতে পারে।

২. অপটোজেনেটিক্স এবং আলোক-নির্ভর থেরাপি
আরেকটি নতুন পদ্ধতি হল অপটোজেনেটিক্স, যা আলোক-নির্ভর থেরাপির একটি অংশ। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট নিউরন বা স্মৃতি চিহ্নিত করে তাদের দুর্বল করতে সক্ষম হন। অপটোজেনেটিক্স একটি প্রযুক্তি, যা জেনেটিকভাবে পরিবর্তিত নিউরনকে আলো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই পদ্ধতিটি মূলত পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং এটি মানসিক আঘাতজনিত রোগের চিকিৎসায় নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

Advertisements

তবে, এটি অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া, যা মানব মস্তিষ্কের গভীর স্তরে কাজ করে। তাই এই পদ্ধতির পুরোপুরি সফল হওয়া এবং মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা এখনও পরীক্ষাধীন।

নৈতিক উদ্বেগ এবং সম্ভাব্য বিপদ
এই নতুন প্রযুক্তির পাশাপাশি অনেকেই এর নৈতিক দিক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্মৃতি আমাদের ব্যক্তিত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে। যদি খারাপ স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা হয়, তবে এটি মানুষের পরিচিতি ও জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে।

এছাড়া, যদি এই প্রযুক্তির অপব্যবহার করা হয়, তাহলে মানুষ তার স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা ভবিষ্যতে একাধিক সামাজিক এবং নৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। স্মৃতি যদি মানুষের অজ্ঞতার সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে, তবে এটি ব্যক্তিত্বের বিকৃতি ঘটাতে পারে।

তাছাড়া, কিছু খারাপ স্মৃতি এমনও থাকতে পারে, যেগুলো আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। সুতরাং, এই স্মৃতিগুলোকে পুরোপুরি মুছে ফেলার প্রক্রিয়া মানব জীবনের জন্য কতটা উপকারী বা ক্ষতিকর হতে পারে, তা এখনও নির্ধারণ করা কঠিন।

এখনো যে খারাপ স্মৃতির মোকাবিলায় অনেকেই নানা ধরনের মানসিক চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে থাকেন, তবে এই নতুন গবেষণা মস্তিষ্কের গভীরে গিয়ে স্মৃতির প্রকৃতির ওপর কাজ করতে সক্ষম হতে পারে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি যদি সফলভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে এটি মানসিক রোগীদের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে। তবে, এর নৈতিক, সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।