হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক (Heart attack) যে কারও ক্ষেত্রে ঘটতে পারে, কিন্তু সুখবর হলো, এটি প্রতিরোধ করা আপনার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রয়েছে। হৃদয়ের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য হৃদরোগের কারণগুলি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। সত্যি কথা হলো, হৃদরোগ প্রায়ই বিভিন্ন কারণের সমন্বয়ে ঘটে, যার মধ্যে জীবনযাত্রার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৫ বছরে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডাক্তারদের মতে, হৃদরোগের ৭-৮টি প্রধান কারণ রয়েছে, কিন্তু স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অবলম্বন করলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। সম্প্রতি ইন্ডিয়া টিভি’র স্পিড নিউজ ওয়েলনেস উইকেন্ড প্রোগ্রামে ফর্টিস এসকর্টস হার্ট ইনস্টিটিউট, দিল্লির চেয়ারম্যান ডা. অশোক সেঠ হৃদরোগের কারণ এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
হৃদরোগের প্রধান কারণ
ডা. অশোক সেঠ জানিয়েছেন, তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে জীবনযাত্রার অস্বাস্থ্যকর পরিবর্তন একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, “আপনার জীবনযাত্রায় কী কী সমস্যা রয়েছে তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনগুলি আপনি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।” তরুণদের মধ্যে কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বেড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: আজকাল তরুণরা কম ব্যায়াম করেন, হাঁটাচলা কম করেন এবং সারাদিন বসে থাকেন। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- স্থূলতা: স্থূলতা বা ওবেসিটি তরুণদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা হৃদরোগের একটি প্রধান কারণ।
- ধূমপান: ধূমপান হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক।
- অতিরিক্ত মদ্যপান: অতিরিক্ত মদ্যপান হৃদয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
- মানসিক চাপ: আধুনিক জীবনযাত্রায় মানসিক চাপ বেড়েছে, যা হৃদরোগের একটি বড় কারণ।
- অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফাস্ট ফুড, তেলযুক্ত খাবার এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত ব্যবহার হৃদয়ের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও, ডা. সেঠ জানিয়েছেন, পারিবারিক ইতিহাসও হৃদরোগের ঝুঁকিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কারও বাবা, মা বা ভাই-বোনের হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তবে তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের তিনটি প্রধান কারণ, যা তরুণদের মধ্যে দ্রুত বাড়ছে। তবে, সুখবর হলো, এই তিনটি কারণই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সঠিক জীবনযাত্রা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
তরুণদের মধ্যে হৃদরোগ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতে তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতের হাসপাতালগুলির তথ্য অনুযায়ী, হার্ট অ্যাটাকের ৫০% রোগী ৪০ বছরের নিচে। এই প্রবণতি কোভিড-১৯ মহামারীর পর আরও বেড়েছে, যখন ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ডা. মুকুল ভাটনাগর, তান্ডা মেডিকেল কলেজের একজন বিশেষজ্ঞ, জানিয়েছেন, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং মানসিক চাপ এই বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ।
হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায়
ডা. অশোক সেঠ জোর দিয়ে বলেছেন, হৃদরোগ প্রতিরোধে আপনার পা আপনার সবচেয়ে বড় সঙ্গী হতে পারে। নিয়মিত হাঁটা, শারীরিক কার্যকলাপ এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। ব্যায়াম সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং নিম্নলিখিত উপকারগুলি প্রদান করে:
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: শারীরিক কার্যকলাপ রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখে এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কমায়।
- স্থূলতা দূরীকরণ: ব্যায়াম শরীরের অতিরিক্ত চর্বি কমায় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- মানসিক চাপ কমায়: শারীরিক কার্যকলাপ স্ট্রেস হরমোন কমায় এবং মনকে শান্ত রাখে।
- কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ: ব্যায়াম খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়।
- অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ত্যাগ: নিয়মিত ব্যায়াম ধূমপান এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের মতো অভ্যাস ছাড়তে সাহায্য করে।
ডা. সেঠ আরও জানিয়েছেন, নিয়মিত ব্যায়াম ওষুধের প্রয়োজনীয়তা অর্ধেক কমিয়ে দিতে পারে। এটি শুধু হৃদয়ের স্বাস্থ্যই নয়, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং আপনাকে সুখী ও সুস্থ রাখে।
অতিরিক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
ব্যায়াম ছাড়াও, হৃদরোগ প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গুরুত্বপূর্ণ:
- স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: ফল, শাকসবজি, ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। ফাস্ট ফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলুন। ডা. এ. অশোক কুমার, রেলা হাসপাতাল, চেন্নাইয়ের একজন ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, জানিয়েছেন, অস্বাস্থ্যকর খাওয়া ধূমপানের মতোই একটি আসক্তি।
- নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। প্রাথমিক সনাক্তকরণ হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন: মানসিক চাপ কমাতে মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা শখের কাজে সময় দিন।
- ধূমপান ত্যাগ: ধূমপান হৃদয়ের রক্তনালীগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধূমপান ছাড়ার জন্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
- পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম হৃদয়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা
হৃদরোগের বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এক্স-এ রিজেন্সি হাসপাতালের একটি পোস্টে ডা. অভিনীত গুপ্ত, অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর, কার্ডিওলজি, তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করেছেন এবং এর কারণ ও প্রতিরোধের উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই ধরনের পোস্টগুলি জনসাধারণের মধ্যে হৃদরোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।
তরুণদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা, কিন্তু সঠিক জীবনযাত্রা এবং সচেতনতার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডা. অশোক সেঠের মতে, নিয়মিত ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ত্যাগ হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মতো নিয়ন্ত্রণযোগ্য কারণগুলি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের উচিত তাদের হৃদয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। হৃদয় সুস্থ থাকলে জীবন হবে আরও সুন্দর ও সুখী।