বাংলা সিনেমা জগত আজ শোকস্তব্ধ। চলে গেলেন প্রবীণ অভিনেতা দেবরাজ রায় (Debraj Roy), যিনি একসময় টেলিভিশনে খবর পাঠক থেকে শুরু করে, পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতো খ্যাতনামা পরিচালকদের ছবিতে অভিনয় করেছেন। বহুদিন ধরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। দেবরাজ রায়ের অসামান্য অভিনয়, সিনেমাপ্রেমী মানুষের স্মৃতিতে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।
অভিনেতার অভিনয় জীবন ও যাত্রা
দেবরাজ রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সাধারণ পরিবারে, কিন্তু তাঁর অভিনয় প্রতিভা তাকে নিয়ে যায় বাংলা সিনেমার জগতে এক বিশেষ উচ্চতায়। তাঁর রূপোলি পর্দায় অভিষেক ঘটে ১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিন্ধন্দ্বী’ সিনেমার মাধ্যমে। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম পা রাখার পরই তিনি তাঁর অভিনয় দক্ষতার জন্য প্রশংসা কুড়ান। এরপর মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ সিনেমায় তাঁর অভিনয় বাঙালির মন ছুঁয়ে যায়।
কর্মজীবনের সাফল্য
দেবরাজ রায় কাজ করেছেন বাংলার একাধিক নামী পরিচালকের সঙ্গে। তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, বিভূতি লাহার মতো পরিচালকরা তাকে নিয়ে সিনেমা বানানোর সময় তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে উচ্চ প্রশংসা করতেন। দেবরাজের অভিনয়ে থাকা সহজাত স্বাভাবিকতা এবং সংবেদনশীলতা তাকে একটি বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছিল। তরুণ মজুমদারের জনপ্রিয় ছবি ‘মর্জিনা-আবদুল্লা’ তে তাঁর অভিনয় আজও বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে স্মরণীয়।
দূরদর্শনেও তিনি বহুদিন ধরে কাজ করেছেন। এক সময়ে বাংলা টেলিভিশনে খবর পাঠক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন দেবরাজ। খবর পড়ার সময় তাঁর কণ্ঠে থাকা দৃঢ়তা এবং সাবলীলতা তাকে এক আলাদা পরিচিতি এনে দেয়। এরপর তিনি টেলিভিশন থেকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে যুক্ত হন।
তাঁর শেষ সময়ের জীবন
দেবরাজ রায় দীর্ঘদিন ধরে নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, এবং তিনি প্রয়াত হন। তাঁর প্রয়াণে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
দেবরাজ রায়ের প্রভাব
দেবরাজ রায় তাঁর অভিনয় জীবনে বহু চরিত্রে অভিনয় করেছেন যা বাঙালি দর্শকদের মনে চিরকালীনভাবে গেঁথে গেছে। তাঁর অভিনয়ে ছিল এক সহজাত ক্ষমতা যা সাধারণ মানুষকে খুব দ্রুত আকৃষ্ট করতো। বাঙালি পরিবারগুলির আড্ডার বিষয় হয়ে উঠতো তাঁর অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। বিশেষ করে, ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বাঙালি দর্শকদের মন জয় করেছিল। বাঙালি সিনেমার এক অধ্যায়ের অবসান ঘটল তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে।
তরুণ মজুমদারের পরিচালিত একাধিক ছবিতে তাঁর কাজের জন্য তাকে সম্মানিত করা হয়েছিল। দেবরাজ রায়ের মতো একজন প্রতিভাবান অভিনেতার চলে যাওয়া বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এক শোকাবহ অধ্যায় হিসেবে থাকবে। তিনি যেমন দূরদর্শন ও সিনেমা, তেমনি নাটক ও টেলিভিশন ধারাবাহিকেও কাজ করেছেন। তাঁর কণ্ঠ, অভিনয় এবং ব্যক্তিত্ব তাকে দর্শকদের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।
দেবরাজ রায়ের পরিবারের প্রতিক্রিয়া
দেবরাজ রায়ের পরিবার এই কঠিন সময়ে শোকস্তব্ধ। তাঁর প্রয়াণে পরিবার থেকে শুরু করে তাঁর অনুরাগী মহলেও গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য এবং চলচ্চিত্র জগতের মানুষজন উপস্থিত থাকবেন। তাঁর সহকর্মীরা, বন্ধুরা, এবং অনুরাগীরা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছেন।
দেবরাজ রায়ের প্রয়াণ বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতা, বিনয় এবং কর্মজীবনের প্রতি নিষ্ঠা তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দিয়েছে। তাঁর স্মৃতি এবং কাজ চিরকাল দর্শকদের মনে অমলিন থাকবে।