বিনা অনুমতিতে চলেছে ট্রাম লাইন তোলার কাজ, হাইকোর্টে প্রশ্নের মুখে রাজ্য সরকার

কলকাতার (Kolkata) ঐতিহ্যবাহী ট্রাম (Tram) ব্যবস্থা, যা শহরের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সম্প্রতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে, শহরের আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে, অন্যদিকে ট্রামের মতো…

Kolkata Tram

কলকাতার (Kolkata) ঐতিহ্যবাহী ট্রাম (Tram) ব্যবস্থা, যা শহরের ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সম্প্রতি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে, শহরের আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে, অন্যদিকে ট্রামের মতো ঐতিহ্যবাহী পরিবহন ব্যবস্থা রক্ষার প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কলকাতা হাই কোর্টের (Kolkata High Court) সাম্প্রতিক নির্দেশনায় ট্রাম সংরক্ষণ নিয়ে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ এবং ইচ্ছার অভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে। আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ট্রাম লাইন (Tram Line) তোলা (Removal) যাবে না, যতক্ষণ না বিষয়টি আদালতে পরবর্তী সিদ্ধান্তে পৌঁছায় বা ট্রাম লাইন তুলে ফেলার ক্ষেত্রে পরবর্তী কোনো অনুমতির (Permission) নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত। একই সঙ্গে আদালত রাজ্যকে ট্রাম সংরক্ষণে গঠিত কমিটির সাথে যোগাযোগ না করে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে তীব্র প্রশ্ন তুলেছে।

এই সমস্যার মূল বিষয়টি হল, কলকাতার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের জন্য রাজ্য সরকারের মধ্যে দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্যোগের অভাব। যেমন, আদালত প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম মন্তব্য করেছেন, “ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।” এর মানে হল যে, যদি রাজ্য সরকার ট্রাম (Tram) সংরক্ষণে ইচ্ছাশক্তি দেখায়, তবে আর্থিক ও অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা অবশ্যই অতিক্রমযোগ্য। একদিকে, যখন রাজ্য ট্রাম ফিরিয়ে আনার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা হাতে নেই বলে দাবি করছে, অন্যদিকে প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন যে, বিদেশের কিছু শহরে যেখানে ট্রাম সংরক্ষণ এবং আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে কলকাতায় কেন তা সম্ভব নয়?

এমন পরিস্থিতিতে, রাজ্য সরকারের দিক থেকে ট্রাম ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থের অভাবের কথা বলা হলেও, এটি অযৌক্তিক মনে হতে পারে। কারণ, কলকাতা শহরের পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলে ট্রাম (Tram) ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বে বহু শহরে, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ট্রাম ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হয়েছে এবং সফলভাবে চলতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, লন্ডন, প্যারিস, সিডনি, মেলবোর্নের মতো শহরে আধুনিক ট্রাম পরিষেবা চলছে, যা শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব করেছে।

এদিকে, ট্রাম লাইন (Tram Line) তোলার জন্য রাজ্য সরকারের যুক্তি ছিল শহরের রাস্তা থেকে ট্রাম লাইনগুলো তোলা হলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে। বিশেষ করে, বাইক ও স্কুটি চালকরা ট্রাম লাইনের (Tram Line) কারণে বিপদের মুখে পড়ছে। তবে, এই যুক্তি অনেকটাই অসম্পূর্ণ এবং একপেশে মনে হচ্ছে, কারণ ট্রামের আধুনিকীকরণ, রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের জন্য নিরাপদ যাত্রাপথ সৃষ্টি করা সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ ছিল ট্রাম লাইনের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং ট্রাম চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা।

কিন্তু কলকাতা (Kolkata)শহরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাথে ট্রামের (Tram) সম্পর্ক এমন কিছু যা শহরের সাংস্কৃতিক পরিচয় হিসেবে রয়ে গেছে। এক সময় শহরের রাস্তা জুড়ে চলত ট্রাম, যা শুধু শহরের পরিবহন ব্যবস্থা নয়, বরং স্থানীয় মানুষের জন্য গর্বের বিষয় ছিল। শহরের নানান ঐতিহাসিক স্থান এবং রাস্তায় ট্রামের চলাচল কলকাতার বিশেষ চিত্র ছিল। আজও অনেক মানুষ যারা প্রাচীন কলকাতার স্মৃতি মনে করেন, তারা ট্রামকে একটি অতীত ঐতিহ্য হিসেবে মনে করেন এবং এটি তাদের জীবনের একটি অংশ।

এছাড়া, আদালত যে কমিটি গঠন করেছিল, তার কার্যক্রমের মধ্যে বড় একটি সমস্যা রয়েছে। সেই কমিটি গঠন করা হয়েছিল যাতে তারা ট্রাম সংরক্ষণ এবং আধুনিকীকরণের জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, গত জানুয়ারি থেকে কমিটি আর কোন বৈঠকই করেনি। এমনকি, সেই কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই রাজ্য সরকার শহরের রাস্তা থেকে ট্রাম লাইন তুলে দিয়েছে। এতে আদালত অবমাননার অভিযোগও উঠেছে। এই ধরনের উদাসীনতা শুধু ট্রাম সংরক্ষণের দিক থেকে নয়, পুরো প্রশাসনিক দক্ষতার ক্ষেত্রেও একটি বড় প্রশ্ন উঠায়।

Advertisements

রাজ্য সরকারের উচিত হবে, শহরের ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা। যদিও ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের জন্য কিছু পরিবর্তন এবং আপগ্রেডেশন প্রয়োজন, তবুও এটি শহরের ঐতিহ্য ধরে রেখে করা উচিত। আধুনিক ট্রাম ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমানো, ট্রাম পরিষেবাকে আরও কার্যকরী এবং নিরাপদ করা সম্ভব। এতে শুধু শহরের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হবে না, বরং কলকাতার ঐতিহ্যও সংরক্ষিত থাকবে।

এছাড়া, রাজ্য সরকার যদি ট্রাম সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ না করতে পারে, তবে একমাত্র জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রাইভেট সেক্টরের সহায়তা প্রয়োজন হবে। যেমন, ট্রামকে একটি পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে পর্যটকরা ঐতিহ্যবাহী ট্রামে চড়তে পারে, তেমনই এর সাথে স্থানীয় জনগণের জন্য সুবিধাজনক পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।

এছাড়া, ট্রাম (Tram) সংরক্ষণ শুধু পরিবহন ব্যবস্থার বিষয় নয়, এটি শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গীকারেরও একটি প্রশ্ন। রাজ্য সরকারের উচিত হবে, এই ঐতিহ্য সংরক্ষণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সকল দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। শুধু আধুনিকীকরণের কথা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা। কলকাতার (Kolkata) প্রতিটি ট্রাম-ই (Tram) এক একটি ইতিহাস, যা বর্তমান প্রজন্মকে প্রেরণা দেবে এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনার জায়গা তৈরি করবে।