বাংলার রাজনীতিতে ২১ জুলাই মানেই তৃণমূল কংগ্রেসের শহিদ দিবস (Shahid Diwas)। প্রতিবছর এই দিন ধর্মতলায় সমবেত হন লক্ষ লক্ষ দলীয় কর্মী-সমর্থক। শহিদ স্মরণ তো বটেই, একইসঙ্গে এই সমাবেশ রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। তবে একুশে জুলাই নিয়ে একটি বিষয় বহু বছর ধরেই নেট দুনিয়ায় ট্রোলের খোরাক হয়ে উঠেছে—তা হল ‘ডিম-ভাত’। এরই বিকৃত রূপ ‘ডিম্ভাত’। অথচ মজার ব্যাপার হল, এই ‘ডিম্ভাত’ (Dimbhaat Controversy) নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সূচনা একুশে জুলাইয়ে নয়, তারও ছ’মাস আগে, জানুয়ারি মাসে, ২০১৯ সালের ১৯ তারিখে।
কী ঘটেছিল ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি?
লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে, বিজেপি বিরোধী বৃহত্তর জোট গঠনের লক্ষ্যে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসভার ডাক দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিল ২২টি বিরোধী দল। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই বলেছিলেন, এটাই ভবিষ্যতের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রথম বড় পদক্ষেপ। ব্রিগেডের ময়দান ভরাতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কর্মী-সমর্থকদের টেনে আনার চেষ্টা হয়। তারই অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, সভার দিন যারা আসবেন, তাদের জন্য ডিমের ঝোল ও ভাতের ব্যবস্থা থাকবে।
তৃণমূলের তরফে এলাকায় এলাকায় চলে দেওয়াল লেখা ও প্রচার। সেখানেই ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক বানান বিভ্রাট। কোথাও কোথাও লেখা হয়—‘ডিম্ভাত’-এর ব্যবস্থা করা হবে। অর্থাৎ ‘ডিম-ভাত’ নয়, একশব্দে ‘ডিম্ভাত’। ভুল বানানটি ধরা পড়তেই শুরু হয় চরম ট্রোলিং। সোশ্যাল মিডিয়া ভরে যায় নানা রকম কটাক্ষে। তৃণমূলের এই ভুল নিয়ে কটাক্ষ করেন বিরোধীরাও। কেউ বলেন, ‘‘তৃণমূল এখন ভাষা শেখাচ্ছে!’’ কেউ বলেন, ‘‘ভাত তো ঠিক আছে, কিন্তু ডিমটা বাংলা থেকে উঠে গেল কবে?’’
শুধু বানান নয়, খাওয়ানোর রাজনীতিও প্রশ্নের মুখে
শুধু বানান বিভ্রাটেই নয়, ‘ডিম-ভাত’ নিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। বিরোধীদের অভিযোগ, ‘‘জনগণের করের টাকায় ডিমের ঝোল-ভাত খাইয়ে রাজনৈতিক জনসভা ভরাতে চাইছে তৃণমূল।’’ কেউ কেউ বলেন, ‘‘রাজনীতির মঞ্চে রাজনৈতিক আদর্শ নয়, এখানে পেটের জন্য মানুষ জড়ো হয়।’’ একাংশের মতে, সেই ব্রিগেড সভার আগে এত বিশাল পুষ্টিকর খাদ্যের প্রচার ছিল আসলে দরিদ্র ভোটারদের আকৃষ্ট করার চাতুর্য।
এরপর ‘ডিম্ভাত’ মানেই তৃণমূল!
সেই একটি বানান ভুলই হয়ে যায় রাজনৈতিক মিম ও ব্যঙ্গবিদ্রুপের রসদ। একুশে জুলাইয়ের শহিদ দিবস এলেই নেটিজেনরা ফের খোঁচা দিতে থাকেন—”তৃণমূলের ডিম্ভাত দিবস ফিরে এসেছে!” কারও কারও মতে, যেহেতু একুশে জুলাইতে প্রতি বছরই বিশাল জমায়েত হয়, তাই সেই দিনেই ‘ডিম্ভাত’ দিবস বলে কটাক্ষ ছুড়ে দেন অনেকেই। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস বলছে, ‘ডিম্ভাত’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ১৯ জানুয়ারির সেই সভা থেকেই।
তৃণমূল কী বলেছিল?
প্রাথমিকভাবে এই বিতর্ক নিয়ে দলের তরফে কোনও প্রতিক্রিয়া না মিললেও পরে একাধিক নেতা দাবি করেন, ‘‘কিছু বিচ্ছিন্ন ভুল বানানকে ঘিরে অকারণ কুৎসা করা হচ্ছে। মানুষের ভালো থাকার জন্য যদি ডিম-ভাত দেওয়া হয়, তাতে দোষ কোথায়?’’ যদিও তাতে বিদ্রুপ থেমে থাকেনি।
রাজনীতির ভাষায় এখন ‘ডিম্ভাত’ একটি পরিভাষা
সোশ্যাল মিডিয়া এবং মিম সংস্কৃতির যুগে একবার যে কিছু ভাইরাল হয়, তা সহজে ভোলে না মানুষ। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য ‘ডিম্ভাত’ এখন একটি স্থায়ী কৌতুকের অংশ। কখনও সেটা বানান বিভ্রাটের কারণে, কখনও দারিদ্র-ভিত্তিক রাজনীতির অভিযোগ তুলে। অনেকেই বলেন, বাংলা রাজনীতিতে যেমন ‘সিঙ্গুর’, ‘নন্দীগ্রাম’, ‘পঞ্চায়েত’ শব্দগুলো প্রতীক হয়ে গেছে, ঠিক তেমনই ‘ডিম্ভাত’ এখন হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রহসনের প্রতীক।
২১ জুলাই তৃণমূলের জন্য এক আবেগঘন শহিদ দিবস। কিন্তু রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এই দিনকে নিয়েও কটাক্ষের শেষ নেই। বাস্তবে যদিও ‘ডিম্ভাত’ শব্দের জন্ম জানুয়ারির এক রাজনৈতিক সমাবেশে, তবুও একুশে জুলাই এলেই এই শব্দ আবার ফিরে আসে নেটদুনিয়ায়। যা বলে দেয়, রাজনীতির মাঠে একটি বানান ভুলও কত বড় হয়ে উঠতে পারে।