২০২৫ সালের জাতীয় নারী নিরাপত্তা রিপোর্ট ও সূচক (NARI 2025) প্রকাশের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের মনে একটি বড় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে—কেন পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহর এই তালিকার শীর্ষ সাতে নেই? রিপোর্টটি অনুসারে, ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় কোহিমা, বিশাখাপত্তনম, ভুবনেশ্বর, আইজল, গ্যাংটক, ইটানাগর এবং মুম্বইের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বা অন্য কোনও শহরের উপস্থিতি নেই, যা রাজ্যের নারী নিরাপত্তা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরেছে।
NARI 2025 রিপোর্টটি জাতীয় মহিলা কমিশন (NCW) এর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি ৩১টি শহরে ১২,৭০০ জন নারীর মতামতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। রিপোর্টে জাতীয় নিরাপত্তা স্কোর ৬৫ শতাংশ নির্দেশ করা হয়েছে, যেখানে ৬০ শতাংশ নারী নিজেদের শহরে সামগ্রিকভাবে নিরাপদ মনে করেন, তবে ৪০ শতাংশ নারী এখনো “অনিরাপদ” বা “অপর্যাপ্ত নিরাপদ” বলে মনে করেন। শহরগুলোর নিরাপত্তা বিচারের ক্ষেত্রে পুলিশের উপস্থিতি, লিঙ্গ সমতা, অবকাঠামো এবং নাগরিক অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে পশ্চিমবঙ্গে এই ক্ষেত্রে কী অভাব রয়েছে, তা বিশ্লেষণের বিষয়।
Also Read | পাটনার আঁচে বিজেপির হাতে আক্রান্ত রাজ্য কংগ্রেস কার্যালয়
কলকাতা, যাকে এককালে “সিটি অফ জয়” বলা হতো, আজ নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন। রিপোর্টে কলকাতাকে নিরাপদ শহরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, বরং এটি কম নিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই তথ্য রাজ্যের শাসকদল এবং বিপক্ষ দল উভয়কেই চিন্তিত করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতায় নারী নিরাপত্তার জন্য পুলিশ বাহিনীতে নারী কর্মকর্তাদের সংখ্যা এবং সিসিটিভি নজরদারির অভাব একটি বড় কারণ। ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট অনুসারে, ভারতের পুলিশ বাহিনীতে নারী কর্মীদের হার মাত্র ৭.২৮ শতাংশ, এবং পশ্চিমবঙ্গেও এই হার খুব বেশি উন্নতি পায়নি।
পশ্চিমবঙ্গে নারী নিরাপত্তার জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলোর মধ্যে মহিলা হেল্পলাইন এবং কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় সিসিটিভি ইনস্টলেশন উল্লেখযোগ্য, তবে এগুলো এখনো পর্যাপ্ত নয়। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে নিরাপদ শহরগুলোতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারী চালক এবং পুলিশের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কলকাতায় এখনো সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়নি। অধিকাংশ নারী শিক্ষার্থী এবং কর্মরত মহিলারা রাতের বেলা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়েছেন। এছাড়া, সামাজিক মনোভাব এবং সংস্কৃতিকে পরিবর্তন না করলে নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না, যা রাজ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তুলনামূলকভাবে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহরগুলো যেমন কোহিমা, আইজল এবং গ্যাংটক নারী নিরাপত্তায় এগিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তাদের ছোটো জনসংখ্যা এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা উল্লেখ করা হয়। এদিকে, মুম্বইয়ের মতো বড় শহরে নারী পুলিশ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তা বেড়েছে। কিন্তু কলকাতায় এই ধরনের উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল।
রাজ্য সরকার এবং সিভিল সোসাইটির কাছে এটি একটি ডাক। নারী নিরাপত্তা বাড়াতে পুলিশ প্রশিক্ষণে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা যোগ করা, সিসিটিভি কভারেজ বাড়ানো, এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারী সুরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা জরুরি। সরকারকে নারীদের মতামত গ্রহণ করে তাদের নিরাপত্তার জন্য নতুন নীতি প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া, সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার মাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করা প্রয়োজন।
কলকাতাকে পুনরুদ্ধার করে এমন একটি শহর হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে নারী নিরাপত্তা এবং সম্মান একসঙ্গে সমৃদ্ধ হবে। তবে এর জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এবং সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। NARI 2025 রিপোর্টটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে, যদি এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়। নারী নিরাপত্তা একটি মানবাধিকার বিষয়, এবং এটি নিশ্চিত করা রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব।