মুর্শিদাবাদ উত্তেজনা নিয়ে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনা

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ (Murshidabad) জেলায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরোধিতা করে গত কয়েকদিন ধরে চলা বিক্ষোভের জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ…

CV Ananda Bose, Mamata Banerjee,

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ (Murshidabad) জেলায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরোধিতা করে গত কয়েকদিন ধরে চলা বিক্ষোভের জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রবিবার এক ভিডিও বার্তায় রাজ্যপাল নিজেই জানিয়েছেন, রাজভবন পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। ভিডিওর শেষে তিনি বাংলায় স্লোগান দিয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দেন। এদিকে, পুলিশ, বিএসএফ এবং আধাসেনা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রশাসন। তবে, গুজব রোধে এবং শান্তি বজায় রাখতে মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে।

ওয়াকফ আইন নিয়ে উত্তেজনার সূত্রপাত

ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, যা গত ২ এপ্রিল ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে পাস হয় এবং ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সম্মতি পায়, তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। এই আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ সম্পত্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন জেলা প্রশাসক, এবং বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। এই পরিবর্তনের বিরোধিতায় মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুটি, জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান এবং শাজুরমোড়ের মতো এলাকায় বিক্ষোভ তীব্র হয়। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ, পুলিশের গাড়িতে আগুন, মোটরসাইকেল ভাঙচুর এবং ট্রাফিক সিগন্যালের ক্ষতি হয়। কিছু এলাকায় পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপ এবং বিক্ষোভকারীদের দ্বারা গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে। পালটা পুলিশের বিরুদ্ধেও গুলি চালানোর অভিযোগ রয়েছে, যার ফলে দুজন আহত হয়েছেন।

প্রশাসনের পদক্ষেপ

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। শুক্রবার রাত থেকে মুর্শিদাবাদে বিএসএফ মোতায়েন করা হয়। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে শনিবার আধাসেনা বাহিনীও জেলায় পৌঁছে যায়। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার শনিবার মুর্শিদাবাদ পরিদর্শন করেন এবং রবিবার সকালে জানান, “পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। গুজবে কান দেবেন না। কেউ আইন হাতে তুলে নিলে পুলিশ তা মেনে নেবে না।” জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার আনন্দ রায়ও বলেন, “পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়েছে। তবে, কিছু গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা থেকে সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে।” প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অংশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে।

ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ

গুজব ছড়ানো রোধ করতে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুটি, ধুলিয়ান এবং জঙ্গিপুরের মতো এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, মালদহ এবং বীরভূমের কিছু অংশেও মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা ব্যাহত হলেও, প্রশাসনের দাবি, এটি শান্তি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। ফরাক্কা-আজিমগঞ্জ রেলপথেও বিক্ষোভের জেরে রেল পরিষেবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে, আরপিএফ মোতায়েনের পর রেল পরিষেবা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে।

Advertisements

রাজ্যপালের বার্তা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রবিবার তার ভিডিও বার্তায় বলেন, “কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অশান্তি কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।” তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জানান, রাজ্য সরকার দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। রাজ্যপালের এই বার্তা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “ওয়াকফ আইন পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর হবে না।” তিনি ইমামদের সঙ্গে বৈঠক করে এই ইস্যুতে আলোচনার পরিকল্পনা করছেন। তবে, বিরোধী দল বিজেপি এই আইনের পক্ষে ‘ওয়াকফ রিফর্মস সচেতনতা অভিযান’ শুরু করেছে, যা ২০ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত চলবে।

স্থানীয় প্রভাব ও সম্প্রীতির আহ্বান

মুর্শিদাবাদের বিক্ষোভের ফলে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়কপথে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বন্ধ ছিল, যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। জেলা শাসক রাজর্ষি মিত্র জানিয়েছেন, “প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”

মুর্শিদাবাদের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতির জটিলতা তুলে ধরেছে। ওয়াকফ আইন নিয়ে বিতর্ক এবং তার প্রতিবাদে সৃষ্ট অশান্তি শান্তি ও সম্প্রীতির গুরুত্ব আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর সমন্বিত প্রচেষ্টা, পুলিশ ও বিএসএফ-এর তৎপরতা এবং আধাসেনা বাহিনীর মোতায়েনের ফলে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এলেও, স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপ ও সহযোগিতা অপরিহার্য। সাধারণ মানুষের প্রতি গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে এই অঞ্চলে সম্প্রীতি ও শান্তি ফিরে আসে।