পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর এক্স হ্যান্ডলের মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আবেদন সমর্থন করি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য। আমরা বিশ্বাস করি যে সব সাধারণ মানুষই আতঙ্কবাদী নয়। আমরা সত্যিই উদ্বিগ্ন।” এই বিবৃতি সেই সময় রোহিঙ্গা বিষয়ে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির সঙ্গে একটি বিরোধ সৃষ্টি করে, যেখানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ভারতের সীমান্ত অতিক্রমণকে নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
রোহিঙ্গা সংকটের পটভূমি
রোহিঙ্গা সংকট ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে তীব্রতর রূপ নেয়, যখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ফলে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মানুষ নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। এই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। তবে, অনেকে ভারতের দিকে রওনা হয়েছিলেন, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যে তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল। সংযুক্ত রাষ্ট্রের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) অনুসারে, ভারতে প্রায় ১৬,৫০০ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত ছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকে শরণার্থী পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
এদিকে, ভারতের গৃহ মন্ত্রণালয় (এমএইচএ) ২০১৭ সালের ৮ আগস্টে একটি পরামর্শ জারি করে বলেছিল যে, “মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ভারতীয় অঞ্চলে অবৈধ প্রবেশ, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, দেশের সীমিত সম্পদের উপর বোঝ বাড়িয়ে তুলেছে এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে তুলেছে।” এই বিবৃতি রোহিঙ্গাদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সংশয় প্রকাশ করেছিল, যেখানে তাদের উপস্থিতিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই পটভূমিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য কেন্দ্রের নীতির সঙ্গে সুস্পষ্ট বিরোধ তৈরি করে।
পশ্চিমবঙ্গের পদক্ষেপ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৭ সালের আগস্টে একটি উদার পদক্ষেপ নেয়। রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, রাজ্যের কিশোর ন্যায়বিচার গৃহে থাকা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ইউএনএইচসিআর কর্তৃক জারি পরিচয়পত্র বিতরণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তটি তখন গুরুত্ব পায় যখন ভারতের ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে লিখিতভাবে অনুরোধ জানান। এই পরিচয়পত্রগুলো রোহিঙ্গা শিশুদের অবৈধ গ্রেফতারি ও নির্যাতন থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল। এই পদক্ষেপটি রাজ্য স্তরে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উদাহরণ হিসেবে গণ্য হয়, তবে এটি কেন্দ্রীয় নীতির সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে।
We do support the @UN appeal to help the Rohingya people.
We believe that all commoners are not terrorists.We are really concerned— Mamata Banerjee (@MamataOfficial) September 15, 2017
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিবৃতি তাঁর সমর্থকদের মধ্যে প্রশংসা পেলেও তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। অনেকে তাঁকে প্রশ্ন করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার পাশাপাশি দেশের মধ্যে নিজেদের শরণার্থী হওয়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের (১৯৯০ থেকে উদ্বাস্তু, ২০২১ সালের তথ্যে প্রায় ৬০,০০০ এখনও শিবিরে) জন্য কেন তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। এক্স পোস্টে তাঁর বিবৃতির পর বিভিন্ন ব্যবহারকারী তাঁকে দেশের নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিছু মতামত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে, যেহেতু তারা মূলত মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আগত।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজ ২০২৫ সালে, রোহিঙ্গা সংকট এখনও সমাধানের দিকে এগোয়নি। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন নির্ভর করছে মানবিক সাহায্যের উপর। ভারতের ক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে, যা রাজ্য সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০১৭ সালের বিবৃতি এখনও তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হিসেবে দেখা যায়, তবে এটি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্নের মাঝে একটি বিতর্কের বিষয় রয়ে গিয়েছে।