কসবার ল’ কলেজে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। অভিযুক্তদের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যোগ থাকার অভিযোগে রাজনৈতিক চাপানউতোর আরও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের অন্দরে একেবারে অন্য এক লড়াইয়ের ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। দলের দুই হেভিওয়েট সাংসদ— কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Kalyan Banerjee) ও মহুয়া মৈত্র (Mahua Moitra)— মুখোমুখি অবস্থানে। এবং তাঁদের তরজার মাঝেই নতুন করে জল্পনার জন্ম: তৃণমূল ছাড়তে পারেন মহুয়া? তাঁর পুরনো দল কংগ্রেসেই কি তিনি ফিরে যাচ্ছেন?
রবিবার বিকেলে এক্স-এ একটি পোস্ট ঘিরে চাঞ্চল্য ছড়ায়। সেখানে লেখা হয়, “দিল্লির মিডিয়া জল্পনা: একাধিক সূত্র নিশ্চিত করছে যে একটি বড় পূর্ব ভারতের দলের একজন “উচ্চপ্রোফাইল” মহিলা সাংসদ কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাঁর ঘনিষ্ঠ কাউকে পূর্ব ভারতের আরেকটি বড় রাজ্যের কংগ্রেস সভাপতি করার চেষ্টাও চলছে। ওই পূর্বাঞ্চলীয় দলের সভাপতি বিষয়টি জানেন এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।” এই পোস্ট নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করেন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে জুড়ে দেন মন্তব্য— “JUST WAIT AND WATCH”। এই বক্তব্যেই নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠে। স্পষ্ট নাম না করলেও তীর যে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের দিকেই ছোড়া হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কসবার ধর্ষণ কাণ্ডে মন্তব্য ঘিরে তুঙ্গে বিতর্ক
২৫ জুন কসবার ল’ কলেজে ছাত্রীর গণধর্ষণের অভিযোগে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হয়ে ওঠে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৭ জুন মুখ খোলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন,
“নিরাপত্তা সবই রয়েছে, কিন্তু একজন বন্ধু যদি বান্ধবীকে রেপ করে তাহলে সেখানে নিরাপত্তা কীকরে দেবে? কলেজের ভিতরে যদি করে, পুলিশ থাকবে কলেজে? নিরাপত্তা তো তার সহকর্মীরা দেবে। সেখানে সহকর্মীরাই রেপ করছে।”
এই বক্তব্যকে ঘিরেই শুরু হয় বিতর্ক। দলের তরফে এক্স-এ পোস্ট করে সতর্ক করা হয় কল্যাণকে। এবং সেখানেই আরও একধাপ এগিয়ে মহুয়া মৈত্র সরাসরি আক্রমণ করেন তাঁকে।
দলীয় সহকর্মীর বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ মহুয়ার
মহুয়া এক্স-এ লেখেন, “ভারতে নারীবিদ্বেষ দলীয় সীমানা ছাড়িয়ে যায়। তৃণমূল অন্যদের থেকে আলাদা কারণ এই ধরনের জঘন্য মন্তব্যের নিন্দা করে। সে যেই বলুন না কেন।”
এই পোস্ট ঘিরে রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়। একদিকে রাজ্যজুড়ে ধর্ষণ নিয়ে উত্তাল পরিবেশ, অন্যদিকে ঘাসফুল শিবিরের অন্দরে স্পষ্ট বিভাজন। মহুয়ার তির্যক মন্তব্যে অস্বস্তিতে পড়ে দল।
পালটা আক্রমণ কল্যাণের
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় রবিবার বলেন, “নারী বিদ্বেষী আমি নই। আমি নারীদের জন্য সবচেয়ে বেশি কথা বলি। মহুয়া মৈত্র এতটাই নারী বিদ্বেষী যে কৃষ্ণনগরে কোনও মহিলা কর্মী বা ভালো নেত্রীকে উঠতে দেয় না। আমি মহিলাদের শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। এটা সবাই জানে। কিন্তু মহুয়া হল নারী হেটার। আই হেট হার।”
এই বক্তব্যে শুধু ক্ষোভ নয়, বরং ব্যক্তিগত রাগও স্পষ্ট।
আরও বিস্ফোরক দাবি কল্যাণের
শুধু বিতর্কে থেমে থাকেননি কল্যাণ। তিনি আরও জানান,
“দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আমাকে বলেছিলেন কালীগঞ্জে গিয়ে সভা করতে। আমি প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু রুকবানুর ও উজ্জ্বল এসে আমাকে জানায়, মহুয়া মৈত্র বাধা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, কল্যাণ ব্যানার্জিকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। আমি দিদিকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি কি বারণ করেছেন? তখন দিদি প্রতীক জৈনকে ফোন করেন। জৈন বলেন, মহুয়া বাধা দিচ্ছেন।”
এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, দলের অন্দরেই শাসনাধীন অন্তঃদ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে।

মহুয়ার রাজনৈতিক যাত্রাপথ
২০০৯ সালে লন্ডনের JPMorgan Chase-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন মহুয়া মৈত্র। প্রথমে কংগ্রেসের যুব শাখায় যুক্ত হন। ছিলেন রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ “আম আদমি কা সিপাহি” প্রকল্পে। ২০১০ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে পাকাপাকি জায়গা করে নেন। ২০১৬ সালে করিমপুর থেকে বিধায়ক এবং ২০১৯ সালে কৃষ্ণনগর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে তাঁকে গোয়ায় তৃণমূলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৪৪ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়ে সংসদে ফেরেন।
তবে কি দলবদলের পথে মহুয়া?
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “JUST WAIT AND WATCH” পোস্ট এবং মহুয়ার অতীত কংগ্রেস সংযোগ— দুই মিলিয়ে জল্পনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঘাসফুল ছেড়ে কি আবার ‘হাত’ ধরবেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ? কংগ্রেসে ফিরে নিজে কি শুধু যোগ দেবেন, না কি পরিবারের কাউকে অন্য রাজ্যের সভাপতির পদে বসানোর দাবিও করবেন? এমন প্রশ্ন ঘুরছে দিল্লির অন্দরে। যদিও মহুয়ার তরফে এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
তবে একটা বিষয় স্পষ্ট— তৃণমূলের অন্দরেই এখন দ্বন্দ্ব তুঙ্গে। এবং এই সুযোগেই বিজেপি ও কংগ্রেস দুই দলই নজর রাখছে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনায়।
সত্যিই কি মহুয়া তৃণমূল ছাড়ছেন? না কি এটা শুধুই কৌশলগত চাপ? উত্তর সময়ই দেবে।
কিন্তু এখনই বলা যায়— তৃণমূলের অন্দর মহল ভালো নেই!