কলকাতা (Kolkata)একসময় তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রসগোল্লা এবং সাহিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, এখন ভারতের ফিনটেক (ফিনান্সিয়াল টেকনোলজি) ইকোসিস্টেমে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুর মতো প্রথাগত ফিনটেক হাবগুলোর ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে, কলকাতা তার উদ্ভাবনী স্টার্টআপ, সরকারি সহায়তা এবং কৌশলগত অবস্থানের মাধ্যমে ফিনটেক খাতে নিজের জায়গা তৈরি করছে। Tracxn-এর তথ্য অনুসারে, কলকাতায় বর্তমানে ৩৬৭টি ফিনটেক স্টার্টআপ রয়েছে, যার মধ্যে ৫১টি ফান্ডেড এবং ৮টি সিরিজ A+ ফান্ডিং পেয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা কলকাতার ফিনটেক ইকোসিস্টেমের উত্থান, এর শীর্ষ স্টার্টআপ, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
কলকাতার ফিনটেক উত্থানের কারণ
১. নিউ টাউন ফিনটেক হাব: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাউসিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (HIDCO) দ্বারা পরিচালিত নিউ টাউন ফিনটেক হাব কলকাতাকে ফিনটেক কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলেছে। এই হাবে ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ প্লট, নেটওয়ার্কিং সুযোগ এবং রাজারহাট ও সল্টলেকের আইটি হাবের নৈকট্য রয়েছে। জাতীয় বীমা কোম্পানি, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, ইউকো ব্যাংক, এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিনান্সিয়াল কর্পোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠান এখানে তাদের অফিস স্থাপন করেছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই হাবে ২৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
২. শিক্ষিত প্রতিভা পুল: কলকাতায় আইআইটি খড়গপুর, আইআইএম কলকাতা, এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিভাবান গ্র্যাজুয়েটরা ফিনটেক স্টার্টআপগুলোতে যোগ দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, TradeLab, একটি ফিনটেক স্টার্টআপ, আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তন ছাত্রদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং SRIC, আইআইটি খড়গপুরের R&D সেল দ্বারা ইনকিউবেটেড। এটি $৫০০,০০০ সিরিজ A ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে এবং Zerodha এবং Lohia Securities-এর মতো ক্লায়েন্টদের সেবা দিচ্ছে।
৩. ডিজিটাল অবকাঠামো ও সরকারি সহায়তা: ভারত সরকারের ডিজিটাল ইন্ডিয়া উদ্যোগ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফিনটেক-কেন্দ্রিক নীতিগুলো কলকাতার ফিনটেক বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। অ্যাঞ্জেল ট্যাক্স বিলোপ এবং বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল নিবন্ধন প্রক্রিয়া সরলীকরণ ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সহজ করেছে। এছাড়া, Fincubation-এর মতো ফিনটেক ইনকিউবেটর কলকাতা এবং মুম্বইতে উদ্যোক্তাদের জন্য মেন্টরশিপ, অফিস স্পেস এবং গ্রাহক নেটওয়ার্ক প্রদান করছে।
৪. ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদা: কলকাতা পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্থিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ডিজিটাল পেমেন্ট, লোন এবং বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্মের চাহিদা ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, mPokket, একটি কলকাতা-ভিত্তিক ফিনটেক, কলেজ ছাত্র এবং তরুণ পেশাদারদের জন্য AI-চালিত মাইক্রো-লোন প্রদান করে, এবং এটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি অর্জন করেছে।
কলকাতার শীর্ষ ফিনটেক স্টার্টআপ
১. mPokket: কলকাতার একটি শীর্ষস্থানীয় ফিনটেক স্টার্টআপ, mPokket কলেজ ছাত্র, সদ্য স্নাতক, গিগ ওয়ার্কার এবং স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য ছোট টিকিট-সাইজের ঋণ প্রদান করে। এটি AI এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ক্রেডিট আন্ডাররাইটিং করে, যা কম বা শূন্য ক্রেডিট স্কোরের ব্যক্তিদের জন্য ঋণ সহজলভ্য করে। mPokket-এর মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং এটি সিরিজ A+ ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে।
২. StockEdge: কলকাতা-ভিত্তিক StockEdge বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যা স্টক মার্কেট ডেটা, বিশ্লেষণ এবং শিক্ষামূলক সংস্থান প্রদান করে। এটি ব্যক্তিগত আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে এবং এর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। StockEdge কলকাতার শীর্ষ তিন ফিনটেক স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে, যা মোট $১৮১ মিলিয়ন ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে।
৩. TradeLab: আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তন ছাত্রদের দ্বারা ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত, TradeLab স্টক মার্কেট ট্রেডিংয়ের জন্য ফিনান্সিয়াল সফটওয়্যার পণ্য তৈরি করে। এর পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে Cyrus (লো-লেটেন্সি অ্যালগো ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম), Pi (অনলাইন ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম), এবং ESIM (পেপার ট্রেডিং ইঞ্জিন)। এটি $৫০০,০০০ সিরিজ A ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে এবং Zerodha, Lohia Securities এবং GRD-এর মতো ক্লায়েন্টদের সেবা দিচ্ছে।
৪. Namaste Credit: ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, Namaste Credit একটি অনলাইন মার্কেটপ্লেস যা ব্যবসায়ীদের ঋণের জন্য ব্যাংক এবং NBFC-এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এটি মালিকানাধীন ক্রেডিট স্কোরিং এবং প্রয়োজনীয়তা ম্যাচিং প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এবং ভারতে ২৪টিরও বেশি ঋণদাতার সঙ্গে টাই-আপ করেছে। এটি SME-দের জন্য ঋণ সহজলভ্য করতে সহায়তা করে এবং বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
৫. Arohan Financial: কলকাতা-ভিত্তিক এই মাইক্রোফিনান্স কোম্পানি ব্যক্তিগত ঋণ এবং নমনীয় পেমেন্ট অপশন প্রদান করে। এটি কলকাতার শীর্ষ তিন ফিনটেক স্টার্টআপের মধ্যে রয়েছে এবং $১৮১ মিলিয়নেরও বেশি ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে। Arohan-এর সহজ আবেদন প্রক্রিয়া এবং গ্রাহক-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
চ্যালেঞ্জ
১. ফান্ডিং সীমাবদ্ধতা: যদিও কলকাতার ফিনটেক স্টার্টআপগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুর তুলনায় ফান্ডিং কম। ২০২৫ সালে ভারতীয় ফিনটেক সেক্টরে মোট ফান্ডিং $৫.৭ বিলিয়ন, যার বেশিরভাগই বেঙ্গালুরু (৪৮%) এবং মুম্বই (৩২%) দ্বারা আকর্ষিত হয়েছে। কলকাতার ফিনটেক স্টার্টআপগুলো মাত্র ৪% ফান্ডিং পেয়েছে।
২. প্রতিভা ধরে রাখা: বেঙ্গালুরু এবং মুম্বইয়ের মতো শহরগুলো উচ্চ বেতন এবং বৃহত্তর সুযোগ প্রদান করে, যা কলকাতার স্টার্টআপগুলোর জন্য প্রতিভা ধরে রাখা কঠিন করে তুলেছে। LinkedIn-এর তথ্য অনুসারে, কলকাতায় ফিনটেক চাকরির সংখ্যা বেঙ্গালুরুর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম (৭৩ বনাম ৩১০)।
৩. বাজার প্রতিযোগিতা: Paytm, Razorpay এবং Cred-এর মতো জাতীয় ফিনটেক জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কলকাতার স্টার্টআপগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই কোম্পানিগুলো বৃহৎ ফান্ডিং এবং বাজার শেয়ারের সুবিধা নিয়ে কাজ করে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
কলকাতার ফিনটেক ইকোসিস্টেম দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের ফিনটেক বাজার $১ ট্রিলিয়ন মূল্যে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। কলকাতার নিউ টাউন ফিনটেক হাব, সরকারি সংস্কার এবং উদ্ভাবনী স্টার্টআপগুলো এই বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। AI, ব্লকচেইন এবং ডিজিটাল পেমেন্টের মতো ক্ষেত্রে কলকাতার স্টার্টআপগুলো নতুন সুযোগ তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, BlockStash Intelligence, FIRST, IIT কানপুরে ইনকিউবেটেড একটি ব্লকচেইন সিকিউরিটি স্টার্টআপ, কলকাতায় ক্রিপ্টো সমাধান তৈরি করছে।
সরকারি উদ্যোগ যেমন স্টার্টআপ ইন্ডিয়া এবং স্থানীয় ইনকিউবেটর যেমন Fincubation কলকাতার ফিনটেক স্টার্টআপগুলোকে আরও শক্তিশালী করছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পিত Vertical City, একটি ৩৮-তলা মিশ্র-ব্যবহারের স্কাইস্ক্র্যাপার, ফিনটেক স্টার্টআপদের জন্য আরও স্পেস এবং সুযোগ প্রদান করবে। এছাড়া, কলকাতার শীর্ষ ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর মধ্যে গত ১০ বছরে প্রতি বছর গড়ে ২৪টি নতুন কোম্পানি চালু হয়েছে, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে।
কলকাতা তার ফিনটেক স্টার্টআপগুলোর মাধ্যমে মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুর বাইরে একটি উদীয়মান হাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। mPokket, StockEdge, TradeLab, এবং Arohan Financial-এর মতো স্টার্টআপগুলো ডিজিটাল লেন্ডিং, বিনিয়োগ প্ল্যাটফর্ম এবং মাইক্রোফিনান্সে উদ্ভাবন নিয়ে আসছে। যদিও ফান্ডিং এবং প্রতিভা ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, নিউ টাউন ফিনটেক হাব, সরকারি সহায়তা এবং শিক্ষিত প্রতিভা পুল কলকাতাকে ভারতের ফিনটেক মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে দিচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কলকাতার ফিনটেক স্টার্টআপগুলো পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্থিক ল্যান্ডস্কেপকে পুনর্গঠন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।