নিজেদেরই আইনের ফাঁদে নাভিশ্বাস কর্পোরেশনের? বাড়ি ভাঙার চক্করে পুরসভারই পকেট ফাঁকা!

বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়ে কার্যত ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ দশা কলকাতা কর্পোরেশনের (Kolkata Corporation)। আর এই জন্য কার্যত দায়ী পুর আইনের (Kolkata Corporation) ফাঁক। এরকমটাই দাবি…

Image of Kolkata Municipal Corporation cracking down on illegal construction.

বেআইনি বাড়ি ভাঙতে গিয়ে কার্যত ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ দশা কলকাতা কর্পোরেশনের (Kolkata Corporation)। আর এই জন্য কার্যত দায়ী পুর আইনের (Kolkata Corporation) ফাঁক। এরকমটাই দাবি অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের। এই অবস্থাতে বেআইনি বাড়ি ভাঙা চলবে? নাকি নিজেদের পকেট বাঁচাবেন? তাই নিয়েই নাকি দ্বিধাবিভক্ত কলকাতা পুরসভার (Kolkata Corporation) আধিকারিকরা।

লোকসভা ভোটের আগেই গার্ডেনরিচ কান্ডে মুখ পুড়েছিল কলকাতা কর্পোরেশনের। গার্ডেনরিচের ফ্ল্যাট ভেঙে পড়া কে কেন্দ্র করে বেআইনি-অবৈধ নির্মাণ নিয়ে উত্তাল হয়েছিল রাজনীতি। স্বয়ং মেয়রকেও পরিস্থিতির বাস্তবতা কার্যত স্বীকার করে নিতে হয়েছিল। কলকাতা কর্পোরেশনের আধিকারিক থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারদের কার্যত হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল সেসময় বেআইনি নির্মাণ আটকাবার জন্য। আর তারপর থেকেই শহর জুড়ে বিভিন্ন বেআইনি নির্মাণ ভাঙার ক্ষেত্রে কাজ শুরু হয়েছে জোর কদমে।

   

কিন্তু পুরসভার এক আধিকারিকের মতে সারা বছর ধরেই এই বেআইনি বাড়ি বা নির্মাণ ভাঙার কাজ চলেতে থাকে। গার্ডেনরিচের ঘটনার পর ব্যাপারটা একটু বেশি মাত্রায় গতি পেয়েছে এই যা তফাৎ। নির্মাণ ভাঙার কাজ কি পুরসভা নিজেই করে? আধিকারিকের বক্তব্য অনুযায়ী পুরসভা খরচা বহন করে ঠিকই কিন্তু নিজেই এই কাজটি করেনা। এর জন্য আউটসোর্সিংয়ের উপরেই ভরসা রাখা হয়। পুরসভার সূত্রে খবর যে, বেআইনি নির্মাণ ভাঙার জন্য চারটি ভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন।

সেঞ্চুরি পার টমেটো, ২০০ ছুঁইছুঁই কাঁচা লঙ্কা! সবজির দামের রেকর্ডে মধ্যবিত্তের পকেটে ছ্যাঁকা

চলতি অর্থবর্ষের হিসাবে এই চারটি সংস্থা মিলিয়ে মোট ৪৫৯টি বেআইনি নির্মাণ ভাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভাঙা হলে তার তো খরচও আছে? যেহেতু সংস্থাগুলিকে নিয়োগ করেছে কলকাতা পৌরসভা, তাই তারা এবার বাড়ি ভাঙার অর্থ দাবি করছে পৌরসভার থেকে। আর সেই অর্থ বেশ বড়সড় অঙ্কের। এখানেই ফ্যাসাদের যাঁতাকলে পড়েছে কলকাতা কর্পোরেশন।

এমনিতেই কলকাতা কর্পোরেশনের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভারে মা ভবানী দশা। তার উপরে গত মাস সাতেক ধরে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পাওনাগণ্ডাও ঠিকঠাক মতো দিতে পারছে না কলকাতা কর্পোরেশন। এমনটাই অভিযোগ উঠছে। এরই মধ্যে চলতি বছরে বাড়ি ভাঙার জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বিল হয়েছে। বকেয়া টাকা ঠিকঠাক না পাওয়ার জন্য সংস্থাগুলি কাজও করতে চাইছে না আর।

এরকম অবস্থাতে পুরসভার আধিকারিকরা এক্ষেত্রে পুর আইনের দিকে অভিযোগ তুলছেন। সাধারণভাবে আইন অনুযায়ী বেআইনি বাড়ি বা নির্মাণ ভাঙার ক্ষেত্রে যাবতীয় আর্থিক দায়ভার জমির মালিককেই নিতে হয়। বাড়ি ভাঙার ১৫ দিনের মধ্যে সে টাকা জমা না দিলে সম্পত্তিকরের সাথে তা যোগ হয়। তার উপরে বছর গেলে নির্দিষ্ট পরিমাণে ইন্টারেস্ট দিতে হয় জরিমানা হিসাবে। আর এখানেই রয়েছে গোড়ায় গন্ডগোল অবস্থা।

সাধারণত বেশিরভাগ বেআইনি নির্মাণ কোন না কোন প্রোমোটারই করে থাকেন। জমির মালিকের সাথে তারা এমনভাবে চুক্তি করেন, যে নির্মাণের কাজ শুধু তাদের, আদতে জমির মালিকানা জমির মালিকের নামই থাকে। ফলে যখন সেই বেআইনি নির্মাণ ভাঙ্গা হয় তখন বিপাকে পড়েন সেই জমির মালিক।

ফের বাংলার নজির, বাড়িতে বসেই এবার রেশন কার্ড আপডেট

যার সাথে আদতে নির্মাণের কোনও সরাসরি সম্পর্কই নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তারা জমি বা পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার বহন করতে না পেরে প্রোমোটারকে ফ্ল্যাটের জন্য জমি দেন। ফলে বেআইনি নির্মাণ ভাঙার খরচ দেওয়ার আর্থিক ক্ষমতাও হয়ত তাদের নেই। জরিমানা করেও এই গোটা বিষয়ের কার্যত কোনো সমাধান মেলেনা। সে ক্ষেত্রে আর্থিক দায়ভার ঘুরিয়ে বহন করতে হয় সেই পুরসভাকেই।

পুরসভার আরেক ইঞ্জিনিয়ারের মতে, এর আগে সাধারণত ছাদে ফুটো করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন বেআইনি নির্মাণ গোটাটাই ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে কোনোভাবেই ফুটো ছাদ মেরামত করে কাজ চালানো না যায়। ফলে খরচও এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। তার উপরে ভাগাভাগির পরে তৈরি হওয়া রাবিশও পরিষ্কারের দায়িত্ব ঘুরিয়ে পুরসভার কাঁধেই পড়ে। কারণ জমির মালিকরা কবে টাকা দেবেন তার তো কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই।

সম্প্রতি নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে পুজোর বৈঠকে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা খরচা হয়েছে পুরসভার। প্রশাসনিক বৈঠকে কেন পুরসভা খরচা করবে সেই নিয়েও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে আধিকারিক মহলে। তারই মধ্যে সামনে এল এই নতুন তথ্য। এবার কি তাহলে পুরসভার আইন বদলের একটা পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে?

জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতা কর্পোরেশনের আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পরিমাণ অনেকটাই বেশি। নিত্য নতুন তাতে ব্যয়ের খাত সংযুক্ত হতে থাকলে আদতে গোটা পুরসভার আর্থিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়বে। সূত্র মারফৎ খবর, যা নিয়ে চিন্তিত খোদ মেয়র ফিরহাদ হাকিমও!

অনেক আধিকারিকদের মতে, বিভিন্ন পুরনো পুর আইনের এই মুহূর্তে সংস্কার করাটা খুব জরুরী। কারণ কথায় আছে আগে ঘর ঠিক করে তারপরে পরকে ঠিক করতে হয়। যদি পুরসভা নিজের এবং নিজের কর্মচারীদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করতে পারে, তাহলে গোটা পুরসভার ব্যবস্থাটাই তো ভেঙে পড়বে। তাই আপাতত বেআইনি নির্মাণ ভাঙার পাশাপাশি নিজেদের ঘরকেও টিকিয়ে রাখতে লড়াই করতে হচ্ছে কলকাতা কর্পোরেশনকে ।