পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন নতুন কিছু নয়। তবে সেসব টানাপোড়েন যখন জনসমক্ষে এসে পড়ে, তখন বিষয়টি হয়ে ওঠে আরও তাৎপর্যপূর্ণ। মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহার গ্রেপ্তারি ঘিরে এবার সামনে এলেন তাঁর বাবা বিশ্বনাথ সাহা। দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার ছেলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তিনি। এমনকি সংবাদমাধ্যমের সামনে ছেলের কীর্তি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন তিনি।
বিশ্বনাথ সাহা বর্তমানে কর্মসূত্রে সাইঁথিয়ায় থাকেন। বেশ কয়েক বছর ধরেই ছেলে জীবনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এমনকি জীবনের কাজকর্ম, জীবনযাপন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরক্ত হয়েই তিনি ঘরছাড়া হয়েছেন। আগে মাঝে মাঝে পৈতৃক ভিটেতে ফিরতেন বটে, কিন্তু গত কয়েক মাসে সেই সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। বিশেষত জীবনকৃষ্ণ সাহার নাম যখন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তখন থেকেই তিনি আর ছেলের মুখোমুখি হতে চাননি।
সোমবার সকালেই খবর পান, ইডি-র হাতে গ্রেফতার হয়েছেন জীবনকৃষ্ণ। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় এই গ্রেপ্তারি। ছেলের এই অবস্থায় অনেক অভিভাবক যেমন ভেঙে পড়েন, তেমনটা হয়নি বিশ্বনাথের ক্ষেত্রে। বরং সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে তিনি জানান, “ছেলের দুর্নীতির দায় আমি নেব না। ওর কাজের সঙ্গে আমি কোনও দিন জড়িত ছিলাম না। বরং ওই সব কীর্তির কারণেই আজ আমি ঘরছাড়া। আমার নিজের সম্মান আছে। ছেলের কীর্তির জন্য আমি কলঙ্কের ভাগীদার হতে চাই না।”
তিনি আরও বলেন, জীবনকৃষ্ণ এক সময় সাধারণ মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন। পরিবারে অভাব ছিল, সংগ্রাম ছিল। সেখান থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠে নামেন তিনি। প্রথমদিকে সাধারণ মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্যই ছিল। কিন্তু পরে ক্ষমতা আসতেই বদলে যায় ছবিটা। বিশ্বনাথের অভিযোগ, ছেলে রাজনীতিতে প্রবেশের পর থেকেই অন্য পথে হাঁটতে শুরু করে। দুর্নীতি, অযথা ক্ষমতার দাপট দেখানো, আর মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি—এসবের ফলেই আজকের এই পরিণতি।
বিশ্বনাথের বক্তব্য, তিনি বারবার ছেলেকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু জীবনকৃষ্ণ তাঁর কথা শোনেননি। বরং বাবার পরামর্শকে তুচ্ছ জ্ঞান করে দূরে সরে যান। ফলত, বাবা-ছেলের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিকে যায়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তাঁকে নিজেকেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে থাকতে হয়।
জীবনকৃষ্ণ সাহার গ্রেপ্তারের পর রাজনৈতিক মহলেও আলোড়ন পড়েছে। তৃণমূলের অন্দরেই এই নিয়ে গুঞ্জন চলছে। রাজ্যের শাসকদল এখন আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এর মধ্যেই বাবার এই বিস্ফোরক মন্তব্য নিঃসন্দেহে চাপ বাড়াবে দলের উপরেও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাধারণত দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নেতাদের পরিবার তাঁদের পাশে দাঁড়ান। কেউ সরাসরি অভিযোগ না করলেও, প্রকাশ্যে লড়াইয়ের কথা বলেন না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ছবিটা একেবারেই উল্টো। বিশ্বনাথ সাহার প্রকাশ্য অবস্থান প্রমাণ করছে যে, জীবনকৃষ্ণের বিরুদ্ধে পরিবারের ভেতরেও অসন্তোষ তীব্র।
এখানেই শেষ নয়, স্থানীয়দের একাংশও বলছেন, বিশ্বনাথ সাহা একজন সৎ এবং সরল মানুষ। দীর্ঘদিন সমাজের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ছেলের রাজনৈতিক উত্থানে গর্ববোধ করেছিলেন শুরুতে। কিন্তু এখন তাঁর মুখেও স্পষ্ট হতাশা। স্থানীয়রা মনে করছেন, বাবার এই প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের ক্ষোভের প্রতিফলনও বটে।
পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে তা এখনই বলা মুশকিল। জীবনকৃষ্ণ সাহার আইনি লড়াই কী দাঁড়ায়, তিনি আদালতে জামিন পান কি না, তা সময়ই বলবে। কিন্তু বাবার এই অবস্থান নিঃসন্দেহে তাঁকে আরও কোণঠাসা করে দেবে।
সব মিলিয়ে, দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহার গল্প কেবল আইনি পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকছে না। পারিবারিক ভাঙন, বাবার সঙ্গে দূরত্ব এবং জনসমক্ষে বিস্ফোরক মন্তব্য—সব মিলিয়ে বিষয়টি আরও নাটকীয় হয়ে উঠছে। একদিকে ছেলের রাজনৈতিক কেরিয়ার প্রশ্নের মুখে, অন্যদিকে বাবার মর্যাদা রক্ষার লড়াই। শেষ পর্যন্ত কার হাতে জয় আসে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।