বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন: ঐতিহ্য ও নবীনতার মেলবন্ধন

বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (Bengal Home Industries) সংগঠনটি ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার…

Bengal Home Industries

বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (Bengal Home Industries) সংগঠনটি ১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার হাতে তৈরি শিল্পকর্ম ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন এবং সেগুলির বাজারে স্থান পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রাথমিকভাবে যেটি ছিল একটি দানশীল ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, তা আজ শতাব্দী পরিক্রমায় তার লক্ষ্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
১৯১৫ সালে বঙ্গীয় বিধান পরিষদে সিল্ক এবং তুলা শিল্পের অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয় এবং এই শিল্পগুলির পুনর্জীবনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। ১৯১৭ সালে, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী নাগরিকের উদ্যোগে বাংলার কুটির শিল্পকে নতুন জীবন দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লেডি কারমাইকেল, যিনি বাংলার গভর্নরের স্ত্রী ছিলেন এবং প্রথম Honorary President হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

   

গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব
বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতীক বা লোগো ছিল এক বিশেষ ধরনের পাখি, যা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। লেডি কারমাইকেল-এর অনেক গ্রামীণ সফরে তিনি স্থানীয় হাঁস ও মুরগিদের দেখেছিলেন, যেগুলি গ্রামের মানুষের জীবনের অঙ্গ ছিল। এই বাস্তববাদী এবং হাস্যরসাত্মক পাখির ডিজাইন, যেটি হস্তশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তা বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রির প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করে।

কর্মসূচি এবং উদ্যোগ
বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে কুটির শিল্পের উন্নয়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন, ১৯১৭ সালে ঢাকা জেলায় একটি চামড়া কারখানা স্থাপন করা হয়, যেখানে স্থানীয় শীতল চামড়া প্রস্তুত করা হত। একইভাবে, কাঁচের পণ্য, মোথার প্যাপার, হাতের কাজ করা সিল্ক এবং তুলা কাপড় তৈরি করা শুরু হয়। বিশেষত সিল্ক শিল্পের পুনর্জন্ম ঘটানোর ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েশনের অবদান উল্লেখযোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলার স্বদেশী আন্দোলন এবং গান্ধীজির খাঁটি কাপড় উৎপাদনের প্রচার এই সংগঠনের উদ্দেশ্য এবং আদর্শের সঙ্গে মিলে যায়, যা ছিল স্থানীয় শিল্প ও হস্তশিল্পের প্রতি সমর্থন জোগানো।

প্রথম শোরুম এবং পরবর্তী পরিবর্তন
বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রথমে হগ স্ট্রীটে একটি ছোট শোরুম স্থাপন করেছিল, যেখানে গ্রামের শিল্পীদের তৈরি পণ্য বিক্রি করা হত। প্রথম বছরে বিক্রি ছিল ২১,০০০ টাকা, পরবর্তী বছর এটি প্রায় এক লক্ষ রুপি পৌঁছায়। পরবর্তীকালে, ১৯৩৫ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত তারা ৪২ চৌরিঙ্গী রোডে গুড কম্পানিয়ন্সের সঙ্গে স্থান ভাগ করে শোরুম চালায়। এরপর ১৯৪২ সালে তারা নিম্ন সুরকুল রোডে চলে আসে। ২০০০ সালে শোরুমটি ভেঙে দেওয়া হলে তারা কেমাক স্ট্রিটে চলে যায়।

বর্তমান শোরুম
২০১৫ সালে, বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন তাদের নিজের তহবিল দিয়ে ত্রিভুজ পার্কে একটি নতুন শোরুম কিনে এবং সেটি আধুনিকীকরণ করে। এখনকার শোরুমটি পুরনো উপকরণের সঙ্গে নতুন ডিজাইন মিশিয়ে একটি চমৎকার সমন্বয় তৈরি করেছে, যা দর্শকদের আকর্ষণ করে।
আজও বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজের শোরুমে বঙ্গীয় সিল্ক, বালুচরি, মুর্শিদাবাদ সিল্ক, টাঙ্গাইল, ধানিয়াখালি, কোটো, ফুলিয়া, ছাপানো তুলা, কাঞ্চন কর্ম, মাদার-অফ-পার্ল, ধাতব সামগ্রী এবং অন্যান্য শৈল্পিক পণ্য বিক্রি হয়। এছাড়া, এটি একাধিক ছোট উদ্যোগের পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করার সুযোগ প্রদান করে, যা স্থানীয় কারিগরদের সমর্থন প্রদান করে।

ভবিষ্যতের পথ
বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন আজও কুটির শিল্পের উন্নয়নে কাজ করছে, এরই মধ্যে প্রদর্শন, কর্মশালা, এবং প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের প্রতি সচেতনতা সৃষ্টি করছে। সংগঠনের ভবিষ্যত লক্ষ্য হলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পের পাশাপাশি আধুনিক প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন শিল্পের প্রচলন করা।

বাংলা হোম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন তার এক শতাব্দী দীর্ঘ ইতিহাসে বহু চড়াই-উতরাই দেখেছে, কিন্তু এর উদ্দেশ্য এবং মুল লক্ষ্য – বাংলার কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের উন্নয়ন – আজও অটুট রয়ে গেছে।