বাঙালি মেরেও জয় বাংলা বলা যায়, এটাও বাংলা ভাষার মজা: দীপ্সিতা ধর

২১শে ফেব্রুয়ারির আগে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব, পরিচয় ও সংকট নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিলেন বামপন্থী যুব নেত্রী দীপ্সিতা ধর (Dipsita Dhar)। সম্প্রতি একটি ফেসবুক…

Dipsita Dhar Raises Concerns on Bengali Language Identity and Hegemony

২১শে ফেব্রুয়ারির আগে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব, পরিচয় ও সংকট নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উসকে দিলেন বামপন্থী যুব নেত্রী দীপ্সিতা ধর (Dipsita Dhar)। সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, “বাঙালি মেরেও জয় বাংলা বলা যায়, এটাও বাংলা ভাষার মজা!” তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছে।

কলকাতায় বাংলার অবস্থা
ফেসবুক পোস্টে দীপ্সিতা অভিযোগ করেন, কলকাতার মতো শহরে, যেখানে বাংলাই প্রধান ভাষা হওয়ার কথা, সেখানে হিন্দির দাপট দিন দিন বাড়ছে। তিনি জানান, বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে গেলে প্রায়শই হিন্দিতে উত্তর আসে, এমনকি যাত্রীর বাংলা বলার পরও ড্রাইভার হিন্দিতেই কথা বলেন। শুধু তাই নয়, এয়ারপোর্টের ডিজিযাত্রার দায়িত্বে থাকা এক তরুণীও হিন্দিতে নির্দেশ দেন। যখন দীপ্সিতা তাকে প্রশ্ন করেন, “তুমি বাংলা জানো না?” তখন সেই তরুণী স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দেন, “জানি!” তাহলে তিনি হিন্দিতে কথা বলছিলেন কেন?

   

এই অভিজ্ঞতা থেকে দীপ্সিতা মনে করেন, ভারতের মতো বহুভাষী দেশে একটিমাত্র ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। বাংলার মাটিতেই যদি বাংলাকে হীনভাবে দেখা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

হিন্দির আধিপত্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
ফেসবুক পোস্টে দীপ্সিতা উল্লেখ করেন, হিন্দিকে ভারতের “রাষ্ট্রভাষা” বা “ইউনিভার্সাল ভাষা” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এর ফলে অন্যান্য ভাষাগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে, বিশেষত বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও সেই চাপ অনুভূত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এই ভাষার আধিপত্য শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক নয়, বরং রাজনৈতিকও। এক ভাষার আধিপত্য অন্য ভাষাগুলোর অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দেয় এবং তার পিছনে একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।

বাংলা মাধ্যম স্কুল বন্ধ হওয়ার কারণ?
২১শে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে দীপ্সিতা পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর দুরবস্থার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কাদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো বন্ধের মুখে?” কেন বাংলার শ্রমিকরা পরিযায়ী হয়ে দিল্লি, বেঙ্গালুরুতে গিয়ে বস্তিতে দিন কাটাচ্ছে? কেন হরিয়ানা ও রাজস্থানে বাঙালিদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে?

এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাঙালির পরিচয় আজ সংকটে। শুধু বাংলাদেশি সন্দেহে নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও আজ নিজেদের পরিচয় নিয়ে লড়াই করছে। এই সংকট আসলে বহুভাষিক ভারতবর্ষের এক ভয়াবহ বাস্তবতা, যেখানে একটি ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

হিন্দি বলা বনাম হিন্দি বলার বাধ্যবাধকতা
ফেসবুক পোস্টের মন্তব্য বিভাগে দীপ্সিতা আরও ব্যাখ্যা করেন যে, হিন্দি বলা কোনো অপরাধ নয়, কিন্তু হিন্দি বলার জন্য কাউকে বাধ্য করা অবশ্যই অন্যায়। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেক মেয়ে কোরিয়ান ভাষা শিখছে শুধুমাত্র K-pop ও কোরিয়ান ড্রামার প্রতি ভালোবাসার কারণে। বহু ভাষা শেখা দোষের কিছু নয়। তবে, রাষ্ট্র যদি একটি ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়, তখন তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, “আপনি ‘দো ঘুট’ গানে নাচতে পারেন, প্রেমিকাকে ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায় অঞ্জলি’ বলতে পারেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যদি আপনাকে বাংলা বলার সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে সেটাই মূল সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গে কর্মসূত্রে থাকা প্রত্যেকের বাংলা জানা ও বলা উচিত, কাউকে অন্য ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করা যাবে না।”

রাজনৈতিক স্লোগান ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্য
পোস্টের শেষ অংশে দীপ্সিতা বলেন, বহু ভাষার মধ্যে রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সব সময়ই প্রতিবাদ হয়েছে। ভগৎ সিং-এর “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, সাফদার হাশমির “হাল্লা বোল”—এসব স্লোগান আসলে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি মনে করিয়ে দেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক স্লোগানও বাংলায় হয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “আয় মমতা দেখে যা” বা “তৃণমূলের সবাই চোর”—এই ধরনের স্লোগান বাংলার রাজনৈতিক মহলে খুব জনপ্রিয়।

২১শে ফেব্রুয়ারির শিক্ষা
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ উচ্ছ্বাস দেখা যায়। কিন্তু দীপ্সিতা মনে করিয়ে দেন, এই দিনটি শুধুমাত্র কবিতা ও আবেগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বাস্তবে বাংলা ভাষার যে সংকট, সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

তিনি বলেন, “আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করব, কিন্তু মনে রাখব না কেন আমাদের সরকারি স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেন বাংলার শ্রমিকরা পরিযায়ী হয়ে যাচ্ছে, কেন বাংলায় থেকেও আমরা হিন্দিতে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি?”

দীপ্সিতার এই বক্তব্য নিছক ভাষার প্রেম নয়, বরং এটি বহুভাষী ভারতে ভাষার রাজনীতি নিয়ে এক গভীর পর্যবেক্ষণ। তার দাবি, ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অস্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলা ভাষার গুরুত্ব রক্ষার জন্য শুধুমাত্র আবেগ নয়, বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই জরুরি।

এই পোস্টের মাধ্যমে দীপ্সিতা শুধুমাত্র ভাষার অধিকারের প্রশ্ন তুললেন না, বরং বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির ভাষা-নীতি নিয়েও এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিলেন।