‘বাবু’র খাতিরে সোনাগাছিতে এবারের কার্তিক পুজো হবে বারোয়ারি

বাংলার নানা অঞ্চলে কার্তিক পুজো (Kartik Pujo) একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। কিন্তু কলকাতার সোনাগাছি (Sonagachhi), যেখানে যৌনকর্মীরা বাস করেন, সেখানে প্রতি বছর কার্তিক পুজো…

Sonagachhi Kartik Pujo

বাংলার নানা অঞ্চলে কার্তিক পুজো (Kartik Pujo) একটি ঐতিহ্যবাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। কিন্তু কলকাতার সোনাগাছি (Sonagachhi), যেখানে যৌনকর্মীরা বাস করেন, সেখানে প্রতি বছর কার্তিক পুজো এক ভিন্ন মাত্রায় পালিত হয়। সাধারণত এই পুজো হয় গোপনীয়তায়, যৌনকর্মীদের নিজস্ব ঘরের অন্দরে, যেখানে সামাজিকভাবে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ বছর সেই প্রথা ভেঙে সোনাগাছির যৌনকর্মীদের সন্তানেরা এক নতুন রূপে পুজো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবার সোনাগাছিতে কার্তিক পুজো (Kartik Pujo) হবে বারোয়ারি (baruari), অর্থাৎ একটি বড় মাপের সামাজিক আয়োজন।

বারোয়ারি কার্তিক পুজো: উৎসবের নতুন দিশাঃ
এ বছরের কার্তিক পুজোকে সোনাগাছির (Sonagachhi) যৌনকর্মীদের সন্তানেরা একটি বারোয়ারি উৎসবে পরিণত করতে চান, যাতে এই আয়োজন সবার কাছে পৌঁছাতে পারে। সোনাগাছির শীতলা মন্দিরের কাছে একটি বড় মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সারা রাত ধরে পুজো চলবে, এবং পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে। এই পুজোর উদ্বোধন করবেন স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা। পুজোর মধ্যে থাকবে নানা রকম খেলনা, ঘুড়ি, লাটাই, লাট্টু, মাটির পুতুল— যা সোনাগাছির যৌনকর্মী সন্তানেরা সংগ্রহ করছেন।

   

রহস্যময় পুরাণের নানা ব্যাখ্যার মধ্যে বাংলায় কার্তিক ঠাকুরের পুজো বিশেষভাবে অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ, আদরের এবং সন্তানপ্রদানকারী হিসেবে পূজিত হন। বাংলার মানুষের বিশ্বাসে, তিনি নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তানপ্রাপ্তির দেবতা। সোনাগাছির (Sonagachhi) যৌনকর্মীরা, যাদের জীবনে অনেকসময় সন্তান আসে না বা তাঁরা সন্তান নিতে চান, তাদের জন্য কার্তিক ঠাকুর বিশেষভাবে পূজিত হন। তারা চাইছেন, তাঁদের জীবনেও এমন ‘‘বাবু’’ আসুক, যাকে এক ধরনের শ্রদ্ধা ও আদর দিয়ে ঘরে তোলা যায়, স্বামী হিসেবে নয়, বরং একটি আদর-ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

‘আমার পদাতিক’ সংগঠনের উদ্দীপনাঃ
সোনাগাছির (Sonagachhi) যৌনকর্মীদের সন্তানেরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘‘আমার পদাতিক’’। সংগঠনটির উদ্দেশ্য একটাই— ঘরোয়া পুজোকে সামাজিক রূপে পরিণত করা, যাতে সোনাগাছির সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে আরও বড় পরিসরে সারা কলকাতা তথা দেশে পৌঁছে দেওয়া যায়। সংগঠনের এক সদস্য রতন জানান, ‘‘আমরা চাই আমাদের ঘরোয়া উৎসবটা সবাই দেখতে পাক, সমাজের সবাই যেন এই উৎসবের অংশ হতে পারে। দিন বদলাচ্ছে, সেই পরিবর্তনে সাড়া দেওয়ার জন্য এই উদ্যোগ।’’

সোনাগাছির (Sonagachhi) যৌনকর্মীদের সন্তানেরা জানাচ্ছেন, আগে তাদের পুজো শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজো করলেও সেটা সবার কাছে পৌঁছত না। কিন্তু এবার তারা চান, পুজো সবার সামনে আসুক। তাদের এই নতুন উদ্যোগে তরুণ-তরুণীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। শুধু পুজোই নয়, সোনাগাছির এই ছোটো সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাচ-গান, ক্রীড়া এবং বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনীও থাকবে, যা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

যৌনকর্মীদের জন্য ‘বাবু’ কার্তিকঃ
বাঙালির মধ্যে কার্তিক ঠাকুরের পূজা সম্পর্কিত নানা বিশ্বাস রয়েছে। এই ঠাকুরকে সাধারণত সন্তান, যুবক বা ‘‘বাবু’’ হিসেবে পূজিত করা হয়। তাঁর চরিত্র, যেভাবে তাঁকে বর্ণনা করা হয়— বেশ উজ্জ্বল, সদা হাস্যজ্জ্বল, আচার-ব্যবহারেও স্নেহশীল— সোনাগাছির (Sonagachhi) যৌনকর্মীরা চান তাদের জীবনেও এমন ‘‘বাবু’’ আসুক, যাকে গ্রহণ করা যায়। সোনাগাছির প্রবীণ যৌনকর্মী শ্যামলী সাঁতরা বলেন, ‘‘আমরা জানি কার্তিক ঠাকুর বিয়ে করেননি, তিনি আইবুড়ো। আমরাও চাই অবিবাহিত বাবু আমাদের জীবনে আসুক। যাঁকে স্বামী হিসেবে ভাবা যাবে। তাই আইবুড়ো কার্তিক আমাদের এত ভালো লাগে।’’

এছাড়া, মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘কেবল ভালো গ্রাহক বা খদ্দের পাওয়ার জন্য নয়, সন্তান পাওয়ার জন্যও কার্তিক ঠাকুরের পুজো করা হয়। আমার মনে হয়, সমাজ যাঁদের পতিতা মনে করে, সেই যৌনকর্মীরা এখানে একটা সম্পর্ক পান। কেউ যাতে পতিত না হয়, সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা কার্তিককে আদর করে ঘরে তুলে নেন।’’

পুরাণের নানা ব্যাখ্যা অনুযায়ী, কার্তিক ঠাকুরের চিত্র একাধিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। একদিকে তিনি বীর দেবসেনাপতি, আর অন্যদিকে তাঁর কামুক রূপও পুরাণে উল্লেখ রয়েছে। তবে বাংলায়, বিশেষত সোনাগাছি (Sonagachhi) অঞ্চলে, তাঁকে ‘‘বাবু’’ কার্তিক হিসেবেই পূজিত করা হয়। যৌনকর্মীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কার্তিক ঠাকুর তাঁকে সন্তান আনার দেবতা এবং অনাগত সন্তানের আশীর্বাদ হিসেবে পূজিত হন। এই বিশ্বাসের কারণে সোনাগাছির যৌনকর্মীরা তাঁর প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেন, যাতে তাঁরা সন্তানপ্রাপ্তির আশীর্বাদ পান।

সোনাগাছির (Sonagachhi) কার্তিক পুজোকে (Kartik Pujo) ঘিরে এবার যে সামাজিক বৈচিত্র্য এসেছে, তা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সোনাগাছির যৌনকর্মীরা, যাদের জীবনে অনেকসময় বৈষম্য এবং সামাজিক অবহেলা থাকে, তারা তাদের উৎসবের মাধ্যমে সেই পুরানো ধারা ভেঙে একটি নতুন আলো, নতুন আশা এবং নতুন সামাজিকতার সূচনা করতে চাইছে। এটি একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়— পরিবর্তন আসছে, আর যৌনকর্মীদের সন্তানরা সমাজের মূল স্রোতে নিজেদের জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রস্তুত।