অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal) এক সময় যাঁর নাম শুনলেই বীরভূমের রাজনীতিতে একধরনের আলোড়ন উঠত, আবার ভয়ও করত বিরোধীরা। এক সময় জেলার কোর কমিটির সভাপতির চেয়ারে বসে প্রশাসন থেকে দল—সবই কার্যত নিয়ন্ত্রণে রাখতেন তিনি।
কিন্তু দুর্নীতি, তোলাবাজি, গরুপাচার কাণ্ডে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ার পর, এবং বিশেষ করে গ্রেফতার হওয়ার পরে, সেই অজেয় প্রতাপ যেন অনেকটাই মলিন হয়ে গিয়েছিল। আইনের চোখে তিনি অভিযুক্ত, জেলও খেটেছেন। তবে তৃণমূলের ভিতরে-বাইরে বহু মহলেই জোর আলোচনা ছিল—অনুব্রতের প্রভাব পুরোপুরি কি আদৌ মুছে গিয়েছে?
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অনুব্রতের অবস্থান নিয়ে নানা চর্চা শুরু হয় কেষ্টর অনুপস্থিতিতে বীরভূমে দাপট দেখাতে শুরু করে একাধিক নেতা। ‘মুকুটহীন রাজা’র সিংহাসনে বসার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছিল দলের ভিতরে। রাজনৈতিক মহলের মতে, ওই সময়ের সুযোগেই অনেকেই নিজেদের জমি শক্তপোক্ত করে ফেলেন। তবে একই সঙ্গে তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন—কেষ্ট এখনও পুরোপুরি গেম থেকে বাদ পড়েননি। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং নিচুতলার দলে যোগসূত্র এখনও প্রবল৷
এর মাঝেই ঘটে যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—স্থানীয় আইসি-কাণ্ড। পুলিশের একাংশের সঙ্গে দলের কিছু নেতার টানাপোড়েন স্পষ্ট হয় এই ঘটনায়। আর এখানেই ফের ‘প্রয়োজনীয়’ হয়ে ওঠেন অনুব্রত মণ্ডল। শাসক দলের নেতৃত্ব বুঝতে পারেন, প্রশাসনের সঙ্গে দলের সম্পর্ক রক্ষা করতে হলে দরকার অভিজ্ঞ নেতৃত্বের—যাঁর হুকুমে এক সময় জেলার প্রশাসনও চলত টেবিল ঠুকে৷
তৃণমূল কংগ্রেস তাই অনেক হিসেব-নিকেশের পর আবার ডাকে ‘কেষ্টদা’কে। হাসিমুখে তিনি ফের কোর কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বে ফিরেছেন। যদিও এখনও তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলি চলছে, নিয়মিত আদালতে হাজিরাও দিতে হচ্ছে। তবে রাজনীতিতে প্রতীকী উপস্থিতি অনেক কিছু বলে। আর সেই জায়গা থেকেই দেখা যাচ্ছে—কেষ্টর প্রত্যাবর্তন শুধু কোনও চেয়ারে বসা নয়, বরং একটি বার্তা। বার্তা যে, বীরভূমে এখনও অনুব্রতের ‘শূন্যস্থান’ কেউ পূরণ করতে পারেননি।৷
দলীয় নেতাদের একাংশ এই প্রত্যাবর্তনে খুশি, কারণ তাঁরা মনে করেন, দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে কেষ্টর মতো নেতার দরকার ছিল। আবার অন্য অংশ একটু আশঙ্কাতেও রয়েছেন—যদি কেষ্ট ফের দাপট শুরু করেন, তবে তাঁরাই কোণঠাসা হয়ে পড়বেন। তবে বাস্তব হল, জেলা তৃণমূল আবার একবার অনুব্রতকে সামনে রেখেই রণকৌশল সাজাতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অনুব্রতর এই প্রত্যাবর্তন তৃণমূলের জেলা রাজনীতিতে একধরনের ভারসাম্য ফেরাবে। দলের পুরনো গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে নিয়ন্ত্রণ আনবে। আবার বিরোধীদের কাছেও এই প্রত্যাবর্তন একটি বার্তা—শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, জনসমর্থনেও কেষ্ট এখনও শক্ত ঘুঁটি৷
শেষ কথা—রাজনীতি মানে শুধুই সমীকরণের অঙ্ক নয়, বরং আবেগ, জনপ্রিয়তা এবং সময়মতো প্রত্যাবর্তনের খেলা। আর সেই খেলাতেই অনুব্রত মণ্ডল যেন ফের দেখিয়ে দিলেন—’গেম ওভার’ এখনও হয়নি। বরং, খেলাটা আবার শুরু হয়েছে নতুনভাবে।