ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই ফের বাংলার দুর্গোৎসব মঞ্চকে রাজনৈতিক কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চলেছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) আসছেন কলকাতায় দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালিয়ানা ঘিরে বিজেপির এই নতুন প্রচেষ্টা কার্যত শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাঁটিতে শক্ত ভিত গড়ারই পদক্ষেপ।
২০২৩ সালে লোকসভা ভোটের আগে অমিত শাহ শেষবার কলকাতায় দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে এসেছিলেন। ২০২৪ সালে তিনি আর আসেননি। কিন্তু ২০২৫ সালে তিনি ফের আসছেন, যা ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের রণকৌশলের সঙ্গেই সরাসরি যুক্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিজেপি সূত্রে খবর, মহালয়ার পরদিনই শাহ কলকাতার উত্তর অংশের একটি নামী পুজো এবং সল্টলেকের ইজেডসিসি প্রাঙ্গণে পশ্চিমবঙ্গ সংস্কৃতি মঞ্চ আয়োজিত দুর্গাপুজোর উদ্বোধন করবেন। এছাড়াও আরও একটি পুজোয় তাঁর উপস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বছর দুর্গোৎসবের সময় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা কলকাতা ও হাওড়ার দুটি পুজো উদ্বোধন করেছিলেন। এবার শাহের সফরকে বিজেপি আরও জাঁকজমকভাবে করতে চাইছে, যাতে বাংলার সাংস্কৃতিক আবহের সঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে যুক্ত করা যায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপি দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে শক্ত ঘাঁটি গড়তে চাইছে। যদিও তৃণমূলের সাংস্কৃতিক রাজনীতির সামনে তারা বহুবার ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতার দুর্গোৎসব ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই তৃণমূলের প্রভাব বেড়েছে। ফলে বিজেপির কাছে দুর্গাপুজো শুধুই উৎসব নয়, এক রাজনৈতিক মঞ্চও বটে।
বাঙালিয়ানার আবেগকে ছুঁতে বিজেপি চায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতাতেও মা দুর্গা এবং মা কালীকে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে অনেকেই মনে করছেন, বিজেপি এবার আরও বেশি করে বাংলার আরাধ্য দেবী ও সাংস্কৃতিক উৎসবকে সামনে রেখে নিজেদের প্রচার সাজাচ্ছে।
অন্যদিকে, বিজেপি শাসিত ভিনরাজ্যে বাংলাভাষী ও বাঙালিদের উপর আক্রমণের অভিযোগ বিজেপিকে কার্যত কোণঠাসা করেছে। এই অবস্থায় বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে “বাঙালির দল” হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। দুর্গোৎসবের মতো আবেগঘন উৎসবে অমিত শাহের উপস্থিতি তাই বিজেপির জন্য প্রতীকী দিক থেকেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে বাস্তব পরিস্থিতি এত সহজ নয়। কারণ, কলকাতার প্রায় সব বড় দুর্গাপুজো কমিটিই সরাসরি রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলের প্রভাবাধীন। পুজো কমিটির অধিকাংশ কর্তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আস্থা রাখেন। সাধারণ মানুষের কাছেও এই বিশ্বাস স্পষ্ট যে বাংলার দুর্গোৎসবকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার পিছনে মুখ্যমন্ত্রীই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
ফলে এবারের দুর্গোৎসবও কার্যত রাজনীতির এক বড় সংঘাতের মঞ্চ হয়ে উঠতে চলেছে। একদিকে অমিত শাহ ও বিজেপি সাংস্কৃতিক আবেগকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, অন্যদিকে তৃণমূল তাদের প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক শক্তিকে আরও মজবুত করতে চাইবে। ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের প্রভাব সরাসরি রাজনীতির ময়দানেও পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অতএব, এবারের দুর্গোৎসব কেবলমাত্র আনন্দ-উৎসব নয়, বরং বাংলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ সমীকরণের দিক থেকেও তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে। অমিত শাহের সফর তাই স্বাভাবিকভাবেই নজরে রাখবে গোটা রাজ্য।